Search
Close this search box.

খনা: এক নারী কিংবদন্তির আখ্যান

যুগ যুগ  ধরে নারীর যে অবদান মানব সভ্যতার ইতিহাস সৃষ্টিতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তা পুরুষ-শাসিত সমাজ ব্যবস্থার কারণেই হোক, কিংবা সেইসকল ক্ষণজন্মাদের ক্ষণিকের আবির্ভাবের জন্যই হোক, আজকাল খুব কম মানুষই তাদের চেনে বা জানে।

এ উপমহাদেশের ঐতিহাসিক নারীদের কথাও এর ব্যতিক্রম নয়। ভারত উপমহাদেশের সংস্কৃত, সভ্যতার ইতিহাস অনেক পুরনো।

যীশু খৃষ্টের জন্মেরও ৩ থেকে ৪ হাজার বছর পূর্বের নিদর্শন আজও ভারতের নানা অংশে পাওয়া যায়।

এত পুরোনো সভ্যতা সেই আদি কালেও জনপ্রিয় ছিল সারা পৃথিবীজুড়ে এর  সংস্কৃত, নানা মসলা এবং নানা বাহারি-পণ্যের কারণে।

ইতিহাসের সেসব দিনের খুব কম মানুষকেই আজ চেনা যায়, যাদের নাম বা কর্মের উল্লেখ আছে পুরাতন কোন পুঁথি বা মানুষের মুখে মুখে ছড়া বা গানে।

কে এই খনা?

এরকমই গ্রাম্য মানুষের মুখেমুখে নানা বচন আর গানে প্রচলিত হয়ে আছে আজও একজনে নাম।

আর তিনিই হলেন খনা, যিনি বিখ্যাত তার “খনার বচন” দিয়ে। আমরা অনেকেই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে তাকে খুঁজে পাই।

তবে শহরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি আজও গ্রামীন লোকেদের মুখে মুখে।

খনা, বা ক্ষণা ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী নারী; যিনি বচন রচনার জন্যেই বেশি সমাদৃত।

কথিত আছে তার আসল নাম লীলাবতী। মূলতঃ খনার ভবিষ্যতবাণীগুলোই ‘খনার বচন’ নামে বহুল পরিচিত।

কলা রুইয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। কিংবা, শীষ দেখে বিশ দিন, কাটতে মাড়তে দশ দিন।

এরকম কৃষিকাজ বা আবহাওয়া নিয়ে অনেক ছোট ছোট ছড়া গ্রামের মানুষেরা আজও গুরুত্বের সাথে মেনে চলে।

এই ছড়াগুলোতেই লুকিয়ে আছে খনা নামের এই অসম্ভব তেজস্বিনী, মেধাবী নারীর কৃতিত্ব, যা সেই আদিকাল থেকে আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এক নারীর প্রতিভাকে।

খনার আসল নাম

গণক বরাহকেই যদি রেফারেন্স ধরা হয় , তবে খনা ছিলো সেসময়ের সিংহলের রাজার মেয়ে, লীলাবতী যার আসল নাম।

খুব শুভকালে জন্মানো এই প্রতিভাধারী নারীকে মানুষ খনা বলে ডাকতো, কারণ তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা। তার থেকেই ক্ষণা- পরবর্তীতে খনা নাম আসে।

তবে খনা নামকরণের সাথে সবচেয়ে বেশি জোরদার হয়ে আছে যে মতবাদ, তার সাথে জড়িয়ে আছে এক রক্তাক্ত ইহিহাস।

যে ইতিহাসে আবারও পুরুষ সমাজের অত্যাচারের এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত মেলে নারীর উপর, নারীর প্রতিভা যখন আবারও হুমকি দিয়েছিল কোন পুরুষের ইগোকে।

রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রধান গণক বরাহের এক ছেলে হয়- মিহির। মিহিরের জন্মের পর বাবা ভবিষ্যত গণনা করে দেখলে, মিহিরের আয়ু আর মাত্র ১ বছর আছে।

তখন বরাহ তাকে একটা পাত্রে করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। সে পাত্র একদা ভাসতে ভাসতে এসে পড়ে সিংহলে।

সিংহলে মিহির বড় হয় এবং একসময়  রাজকুমারী লীলাবতীকে বিয়ে করে। পরবর্তীতে তারা আবার ভারতের মূল ভখন্ডে বরাহের কাছে ফিরে যায় ঘটনাক্রমে।

সেখানে মিহিরও একসময় রাজসভায় একজন গণকের পদে দায়িত্ব পায়।

বরাহের সময়ে রাজ্যে দেখা যায় এক মারাত্মক আবহাওয়ার বদল।

রাজার উপদেষ্টা বরাহ হলেও, আমজনতার কাছে পুত্রবধূ লীলাবতীই বেশি বিখ্যাত হতে থাকে তার গণনা আর দূরদর্শিতার মেধা দিয়ে।

খনার জন্ম নিয়ে মতবাদ

খনার জন্ম  নিয়ে এখন পর্যন্ত ২টি মতবাদ বেশ জোড়ালো ভাবে রয়েছে।

তার মধ্যে একটি হলো, তার শ্বশুর, আরেকজন বিখ্যাত গণক এবং গণিতবিদ- বরাহ এর জীবণকালকে রেফারেন্স ধরে। 

আরেকটি রেফারেন্স জোর দেয় খনার বচনে বাংলা ভাষার বিবর্তিত রূপকে ঘিরে।

একটি ধারণা অনুযায়ী, খনা জন্মেছিলো ওপার বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসতের দেউলিয়া নামক গ্রামে।

রাজা ধর্মকেতুর আমলে জন্মানো খনার  বাবা ছিলেন অটনাচার্য।

তাঁর বাবার এই পরিচয় পাওয়া যায়, খনারই এক বচনে- “ আমি অতনাচার্যের বেটি, গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি।“

রাজা ধর্মকেতুর রাজ্যের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ খুঁড়তে গিয়ে এর বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়।

যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটা ঢিবির ন্যায় পাকা সমাধি, যা স্থানীয় লোকেদের কাছে “খনা-মিহির ঢিবি” নামেই পরিচিত।

তবে মতান্তরেও কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদরা দাবি করেন, সে এলাকা আরও পুরোনো খনার সময়ের চেয়ে।

তাই সমাধিখানা আদৌ খনার কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ আছে।

শ্বশুর বরাহের রেফারেন্সে যদি আলোচনা করি, তবে খনার জন্ম হওয়ার কথা ৬ষ্ঠ খৃস্টাব্দের মাঝামাঝি।

যেহেতু বরাহ ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রধান গণক, এবং ইতিহাস অনুসারে তার আয়ুকাল ৫০৫ হতে ৫৯০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত।

কিন্তু সে হিসাবে দেখা দেয় আরেক বিপাক- বরাহের সময়কালে বাংলাভাষার যে ধাঁচ ছিলো, তা প্রাচীন চর্যাপদের চেয়েও কঠিন ছিলো।

খনার বচন

তখন খনাই নানা ছড়ায় ছড়ায় মানুষকে গাইড করতো/ নেতৃত্ব দিতো। যেমন- কলা রুইয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত।

অর্থাৎ কলাগাছ লাগায়েই পাতা কেটো না। তাইলে কলা হবে না। কলা না হলে টাকা আসবে না।

সংসারে অভাব হবে, কলা বিক্রি করতে , পর্যাপ্ত কলাই যদি না পাও।

আরও একটা বিখ্যাত বচন- ষোলো চাষে মুলা, তার অর্ধেক তুলা, তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।

এর মানে, ১৬ টা চাষাবাদের পর, মাটির অবস্থা এমন হয় যে, মূলা চাষ তখন যদি করা হয়, অনেক ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

তার অর্ধেক- মানে ৮ টা চাষাবাদের পর ভালো ফলন পেতে চাইলে তুলা চাষ করা দরকার। এর অর্ধেক পরিমাণ- ৪ চাষাবাদের মাটিতে ধানের ফলন অনেক ভাল হয়। আর পান এর জন্য, কোন চাষাবাদের মাটি লাগে না। এমনিতেই ভাল ফলন হবে।

যে কারণে খনার বচন এখনও সহজবোধ্য

অন্যদিকে খনার বচনগুলোতে ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলো অনেক সহজবোধ্য লাগে আমাদের কাছে। এটা আমরা জানি যে, ভাষা সদা পরিবর্তনশীল।

আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে বাংলা ভাষার যে হাল ছিলো, তা আজকাল মানুষ লিখিতভাবেও ব্যবহার করে নাহ, বরং বেশ দুর্বোধ্য।

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের কবি রবীন্দ্রনাথ কিংবা তারও আগে আসা পরিচিত কবিদের সাধু ভাষায় লেখা কবিতাই কেমন ঠেকে আমাদের কাছে।

তাহলে সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে, ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বাংলা ভাষার অবস্থা কতটা ভিন্নধর্মী ছিল আমাদের সময়ের তুলনায়।

কিন্তু খনার বচনের আধুনিকতাকে যদি স্টান্ডার্ড ধরি, তাহলে খনার আবির্ভাব নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতকে পড়ে।

তখন বরাহ আর খনার জীবনকাল আর একই সময়সীমায় থাকে না। শ্বশুর-বৌমার মধ্যে সময়ের ফারাক চলে আসে প্রায় ৩০০ বছর!

অবশ্য বরাহের পুত্রবধূর পক্ষেও একটা জোড়ালো যুক্তি হলো- খনার বচনগুলোর সাথে কালক্রমে আরও মানুষের বচন কালক্রমে যুক্ত হয়েছে।

খনার বচনের উপকারিতা

খনা বেশ কিছু বচনে আবহাওয়া , কৃষিকাজ, সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে গণনা আর ভবিষ্যৎবাণী করেছিল।

পরবর্তীতে মানুষেরা কালের সাথে মিলিয়ে আরও কিছু ছড়া কাটে, কিন্তু তা বিখ্যাত খনার নাম অনুসারে খনার বচন নামেই পরিচিত হয়।

সেদিক থেকে ভেবে নিলে, খনার বচন কোন একক ব্যক্তির নয়, বরং যুগে যুগে বাংলার গ্রাম্য সমাজের কৃষক, বধূ নানা মানুষের দৈনন্দিন জীবণকালের এক অভিজ্ঞতার সংগ্রহ।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, নানা প্রত্নতত্ত্ববিদ, ভাষাবিদ এবং গবেষকদের মতে, খনার অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল প্রাচীন ভারতে।

এবং তিনি সেই আমলের অসম্ভব বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী, গণিত বিশেষজ্ঞ এবং দুরদর্শি মহিলা ছিলেন।

দূরদুরান্ত থেকে মানুশ তার কাছে ছুটে আসতো তার নির্দেশনা পেতে, সমস্যার সমাধান করাতে।

খনার গ্রহনযোগ্যতা

সেসময়ের কৃষকদের কাছে এসব গাইডলাইনের ভূমিকা ছিলো মারাত্মকরকম প্রয়োজনীয়। দূর-দুরান্তের মানুষ খালি কৃষিকাজ না, ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়েও খনার কাছে ছুটে আসতো।

খনা তার জ্ঞান, গণিত আর দূরদর্শিতা দিয়ে সকল সমস্যারই খুব বাস্তবসম্মত সমাধান দিত; যার ফলে দিলে দিলে বরাহ গণিকের খ্যাতি এবং আয় উভয়েই কমে যেতে লাগে এই মেয়েমানুষটার জন্য।

খনার পরিণতি

তৎকালীন বড় বড় গণকও পেরে উঠছিলো না খনা তথা লীলাবতীর মেধার কাছে।

তবে খনার জীবণে বিপদ ঘনিয়ে আসে, যখন স্বয়ং রাজার একটা সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছিল রাজ্যের সব গণক এবং গণিতবিদ, এমনকি শ্বশুর বরাহও।

খনা সে সমস্যার সমাধান করে রাজার বিশেষ নজরে যদি চলে আসে, তবে এতদিনে এই পৌরষত্বের কি মূল্য থাকলো।

টিপিক্যাল ইগোইস্টিক বরাহ এই আতংক,হিংসা এবং অনিশ্চয়তায় ছেলে মিহিরকে হুকুম দেন- খনার জিহবা কেটে ফেলতে, যেন খনার মুখ দিয়ে আর একটাও শব্দ বের না হয় ভবিষ্যত সংক্রান্ত!

ছেলে মিহির আজকের যুগের ছেলেদের মতোই অতি পিতাভক্ত, যার মাথায় বউয়ের প্রতি না ছিল কোন আবেগ, দায়িত্ব।

পিতৃ আদেশ পালন করতে সাথেই সাথেই কেটে ফেলে বউ এর জিহ্বা।

অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ধীরে ধীরে জীবণের অবসান ঘটে , সে সময়ের ভারত কাঁপানো, সকল পুরুষকে জ্ঞানে, গণিতে টক্কর দেয়া নারী- লীলাবতীর।

জিহ্বা কাটায় বোবা হওয়ার জন্যই, উড়িয়া ভাষায় বোবার প্রতিশব্দ “খোনা” নামে ডাকা হয়, যা পরবর্তীতে খনা নামে পরিবর্তীত হয়- এটাও অনেকে মনে করেন।

তবে নামকরণ যে কারণেই হোক না কেন, খনা নামের এই নারীকে তৎকালীন পুরুষেরা হত্যা করে চেষ্টা করেছিল দমিয়ে রাখতে।

কিন্তু তার মেধা, প্রতিভার খ্যাতি ইতিমধ্যে এত্ত ছড়িয়ে গেছিল যে , সে পুরুষেরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে খনার নামকে ধামাচাপা দিতে।

খনা সে আমলেই, কী পরিমাণ দূরদর্শি ছিল, তার প্রমাণ মেলে আবহাওয়া কিংবা কৃষিকাজে তার বচনগুলো দেখে।

খনার আখ্যান

তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ছিল কৃষিপ্রধান। মানুষের কাছে এত উন্নত সরঞ্জাম ছিল না , আবহাওয়াকে এত ভাল করে বুঝতো না যে, সেই মতো চাষাবাদ করবে।

একজন নারী কীভাবে এগিয়ে যাবে, বরাহ আর তার পুত্র মিহিরের মতো পুরুষ থাকতে! এরই ফলস্বরূপ আরও একবার সমাজের বলির শিকার হল এক প্রতিভাধর নারী!

তবে মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমে, জীবনকাল তো একদিন শেষ হবেই, বরাহ-মিহির এই কথাটাই ভুলে গিয়েছিলো নিজেদের পৌরষত্বের দম্ভে।

খনাকে হত্যা করেই ভেবেছিল, মিটিয়ে দিতে পারবে এই মেধাবী নারীর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে।

কিন্তু খনার দ্বারা উপকৃত মানুষ ভুলেনি সেই নারীকে। শুরুতে ছড়াগুলো হয়তো সেসময়ের মতো কঠিন ভাষাতেই ছিলো।

পরে কালের স্রোতে মানুষের মুখে মুখে ভাষার ধর্মানুসারেই পরিবর্তীত হয়ে, অপেক্ষাকৃত সহজ বাংলায় যুগ যুগ ধরে টিকে রয়েছে সেই কিংবদন্তি নারীর কীর্তিগাঁথা- খনার বচন যার নাম; বাংলার ইতিহাসে প্রথম মহিলাকবি লীলাবতী খনার আখ্যান।

তথ্যসূত্র

  • “কিংবদিন্তির খনা ও খনার বচন” – পূরবী বসু (২০১৫)
  • “খনা” – আজহার ইসলাম, বাংলাপিডিয়া
  • “খনার বচন কৃষি ও কৃষ্টি” – আলি নওয়াজ (২০১৪)