আমরা সবাই জানি, সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রা ভায়োলেট রে বা অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সানস্ক্রিন আমাদের ত্বককে রক্ষা করে।
এছাড়া ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধেও সানস্ক্রিন বেশ কার্যকর। কিন্তু আমরা সবাই সানস্ক্রিন ব্যবহারের সময় কিছু সাধারণ ভুল করেই থাকি।
মনে রাখবেন, এটা শুধু শরীরে ব্যবহারের কোনো সাধারণ ক্রিম নয়। এর অনেক কার্যক্ষমতা রয়েছে, যা ত্বকের সুস্থতায় খুবই প্রয়োজন।
বাড়িতে আছেন বলেই যদি সানস্ক্রিন মাখা বন্ধ করে দেন, তবে ত্বকের উপরে দারুণ অবিচার করা হবে।
আশ্চর্য লাগছে? মনে হচ্ছে তো, বাড়ির ভিতরে আবার রোদ কোথায়?
আসলে আপনি বাড়ির ভিতরে থাকার সময় রোদ থেকে সুরক্ষিত থাকেন বটে, কিন্তু সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মি ঘরের মধ্যেও আপনার ত্বকের একইরকম ক্ষতি করে।
কিন্তু কীভাবে? আসুন জেনে নেয়া যাক।
রোদে না গেলেও সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি যেভাবে আমাদের ক্ষতি করে।
ঘরের জানলায় গ্রিল থাকলে তার মধ্যে দিয়ে অবাধে যাতায়াত করতে পারে ইউভি এ আর ইউভি বি।
এই ইউভি অর্থাৎ আলট্রা ভায়োলেট ত্বকে রোদজনিত ট্যান, বলিরেখা, দাগছোপ পড়ার জন্য দায়ী।
অন্যদিকে জানলায় সাধারণ যে কাচ লাগানো হয়, তা ইউভি এ শুষে নিতে পারলেও ইউভি বি আটকাতে পারে না। ফলে ত্বকের ক্ষতি হয় একইভাবে।
এমনকি, আকাশে মেঘ থাকলেও সানস্ক্রিন মাখতে হবে। অনেকেই ভাবেন মেঘলা বা বৃষ্টিমাখা দিনে সানস্ক্রিন মাখার দরকার নেই। এটা সবচেয়ে বড় ভুল।
মেঘাচ্ছন্ন দিনেও ইউভি সূচক একইরকম সক্রিয় থাকতে পারে, এবং ত্বকের সমান ক্ষতি করে।
তাই আকাশ পরিষ্কার হোক বা মেঘলা আর আপনি বাড়ির ভিতরে থাকুন বা বাইরে, সবসময় ব্রড স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন মেখে থাকতে ভুলবেন না!
অনেকেই রোদ না থাকলে অথবা আকাশে মেঘ থাকলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করে না। মনে করে, এখন তো রোদ নেই, তাই সানস্ক্রিন ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
কিন্তু এ সময়েই ত্বকের অনেক বেশি ক্ষতি হয়। কারণ, ক্ষতিটা সূর্যের তাপের কারণে হয় না, ইউভি রশ্মির কারণে হয়। তাই মেঘাচ্ছন্ন দিনেও সানস্ক্রিন লাগাতে ভুলবেন না।
এখন তো জেনে গেলেন, যদি রোদে বের নাও হন তবুও আপনি শঙ্কামুক্ত নন। সরাসরি রোদে না গেলেও, আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি আপনার ক্ষতিটা করবে ঠিকই।
সানস্পট, হাইপারপিগমেন্টেশনও তৈরি হয় ঐ আলট্রা ভায়োলেটের কারণেই।
তাহলে করণীয় কী?
ছাতা না নিয়ে কিংবা সানস্ক্রিন ব্যবহার ছাড়া বাইরে হেঁটে বেড়ান তো? আয়নায় নিজের মুখটা দেখেছেন কখনও ভালো করে?
আমাদের দেশে যদি বিনা ছাতায় ঘুরে বেড়ান, তাহলে আপনার ত্বকের কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা হবে।
রোদে বের হলে ব্রড স্পেকট্রাম সানস্ক্রিন মাখতেই হবে। রাতের ক্রিমে যেন রেটিনল অবশ্যই থাকে।
রেটিনল যুক্ত ক্রিম বা লোশন আপনার ত্বকের কোলাজেন সুরক্ষিত রাখবে।
অবশ্যই এস.পি.এফ এর মাত্রা দেখে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। এস পি এফ ছাড়া সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে কোনও লাভ হবে না।
এস.পি.এফ কী?
‘এস.পি.এফ’-এর অর্থ ‘স্পেসিফিক প্রোটেকশন ফ্যাক্টর’।
যে কোনও সানস্ক্রিন আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে আমাদের ত্বককে কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে, ‘এস পি এফ’ দিয়ে আদতে সেটাই মাপা হয়।
সানস্ক্রিনে এই এই এস.পি.এফ এর মাত্রা যতটা বেশি হবে, আপনার ত্বকের সুরক্ষাও ততটা বেশি হবে।
অর্থাৎ, এস.পি.এফ-৩০ যতটা সুরক্ষা দেবে, এস.পি.এফ-৫০ এর ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবে তার চেয়ে বেশি সুরক্ষা পাওয়া যাবে।
চেষ্টা করুন নূন্যতম এস পি এফ-৩০ ব্যবহার করার। এতে করে ত্বক এর ক্ষতি হবে না এবং স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বজায় থাকবে।
তবে যদি কড়া রোদে বের হবার দরকার পড়ে, তবে অবশ্যই এস.পি.এফ-৫০ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
সানস্ক্রিন ও সানব্লক এর পার্থক্য
অনেকের একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে সানব্লক ও সানস্ক্রিন একই জিনিস। তবে, সানব্লক ও সানস্ক্রিন একই কাজে ব্যবহৃত হয় কিন্তু কাজ করার ধরন আলাদা।
সানস্ক্রিন ত্বকের উপর প্রলেপ তৈরি করে, একারণে অতি বেগুনি রশ্মি ত্বকের ভিতরে যেতে পারে না। সানস্ক্রিনে যেসব উপাদান থাকে তা সানব্লকে থাকে না।
অন্যদিকে, সানব্লক সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করে বলে রশ্মি ত্বক পর্যন্ত যেতে পারে না।
বলা যেতে পারে, সানব্লক অপেক্ষা সানস্ক্রিন ব্যবহার করা ত্বকের জন্য ভালো।
কোন সময়ের রোদ বেশি ক্ষতি করে ত্বকের?
সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সময়ের রোদ বেশি ক্ষতিকর ত্বকের জন্য। তাই ওই সময়টা একটু এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো হয়।
বিশেষত গরমকালটা। ওই সময় রোদ খুব চড়া থাকে। তাই দিনের বাকি সময়টা বাইরের কাজ করে নিতে পারলে ভালো।
তবে খুব বেশি কাজ থাকলে তো বেরোতেই হবে। তাই সেই সময়ের ভরসা সানস্ক্রিন তো আছেই। বেশি এস.পি.এফ যুক্ত সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিতে হবে।
বাইরে বের হবার ৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন
অনেকেই বাড়ি থেকে বের হবার জাস্ট একটু আগেই সানস্ক্রিন লাগান। ওই কয়েক মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগিয়ে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।
তাই বাইরে যাবার অন্তত ৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন মাখা দরকার। স্কিনকে এটা নিতে একটু সময়তো দিতেই হবে।
আর সানস্ক্রিন অন্তত এস.পি.এফ ৩০ হওয়া দরকার। কমপক্ষে এস.পি.এফ ৫০ আরও বেশি হলে আরও ভালো।
যারা সারাদিন বাইরে ঘুরে ঘুরে কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি এস.পি.এফ হলে ভালো।
খুব বেশি রোদে বের হলে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অন্তর সানস্ক্রিন লাগানো দরকার।
আমরা অনেকেই প্রচুর প্রচুর সানস্ক্রিন মাখি আর ভাবি এতেই বুঝি রোদ থেকে সুরক্ষিত থাকবে ত্বক! আসলে ব্যাপারটা অতটাও সহজ নয়!
সানস্ক্রিন ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করে ঠিকই, কিন্তু গাদা গাদা সানস্ক্রিন মাখলেই ত্বক সুরক্ষিত হয় না।
বরং সানস্ক্রিনের পুরো উপকারিতাটা পাওয়ার জন্য কেনার সময়ই মাথায় রাখুন কয়েকটা জরুরি বিষয়।
সানস্ক্রিন কেনার সময় যেগুলো খেয়াল করতে হবে
কোনো প্রসাধনীর মেয়াদ ও উপাদান না দেখে কিনা উচিত না।
খেয়াল করতে হবে সানস্ক্রিনে যেন টিটানিয়াম ডিঅক্সাইড, অক্টাইল মেথোক্সিসিনামেট (ওএমসি), অ্যাভোবেনজন ও জিঙ্ক অক্সাইড থাকে।
ত্বক ব্রণ প্রবণ বা তৈলাক্ত হলে জেল বা পানি ভিত্তিক অথবা ‘নন-কমেডোজেনিক এবং হাইপোঅ্যালার্জেনিক সমৃদ্ধ সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
নন-কমেডোজেনিক সানস্ক্রিনই কিনুন। এই সানস্ক্রিন ত্বকের রোমছিদ্র বন্ধ করবে না, ফলে ব্রণের উপদ্রবও হবে না।
সানস্ক্রিন যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সানস্ক্রিন ব্যবহারের প্রথম শর্তই হলো তা আপনার ত্বককে এমনভাবে সুরক্ষিত রাখবে যাতে আলট্রা ভায়োলেট বি রশ্মির আপনার ত্বকে ঢুকতেই না পারে।
ইউভি-বি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করতে নূন্যতম ৩০ থেকে ৫০ এস.পি.এফ-যুক্ত সানস্ক্রিন কিনুন।
ইউভি-বি রশ্মির পাশাপাশি ইউভি-এ থেকেও সুরক্ষা দরকার।
কেনার আগে সানস্ক্রিনের লেবেলে PA+, PA++, PA+++ এরকম কিছু লেখা আছে কিনা দেখে নিন। যতগুলো প্লাস চিহ্ন থাকবে, আপনার ত্বকও ততই ইউভি-এ থেকে সুরক্ষিত থাকবে।
মুখের সান প্রোটেকশন ক্রিম খুব ভারী হলে মুশকিল। তাই হালকা মিস্টের মতো সানস্ক্রিন স্প্রে ব্যবহার করুন। মুখ বাদে বাকি শরীরে অবশ্য ভারী সানব্লক মাখতে পারেন।
সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান থাকলে সে ক্ষেত্রে আপনার সানস্ক্রিনের এসপিএফ অন্তত ৫০ হতে হবে।
সানস্ক্রিন মাখার আগে মনে রাখুন
সারা বছর সানস্ক্রিন মাখুন। বৃষ্টি হলে বা ঠান্ডা পড়লেও সানস্ক্রিন বাদ দেওয়া যাবে না।
শুধু মুখে নয়, শরীরের সমস্ত অনাবৃত অংশে সানস্ক্রিন মাখুন। সানস্ক্রিন মাখার আগে প্যাচ টেস্ট করে নিন। তাতে আচমকা অ্যালার্জিতে ভুগতে হবে না।
তেলতেলে ত্বক হলে জেল-বেসড বা ওয়াটার-বেসড সানস্ক্রিন মাখুন। শুষ্ক ত্বক হলে বেছে নিন অয়েল-বেসড সানস্ক্রিন।
বাড়ির বাইরে থাকলে দু’ তিন ঘণ্টা পর পর সানস্ক্রিন মেখে নিতে হবে।
আমরা শুধু সেই জায়গাগুলোতেই সানস্ক্রিন ব্যবহার করি, যেখানে পোশাক থাকে না।
এ কারণে ওই জায়গাগুলোতে কালচে ভাব থাকে, যা পুরো শরীর থেকে আলাদা মনে হয়। তাই বাইরে যাওয়ার আগে পুরো শরীরে সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
যদি আপনার অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা থাকে, তাহলে অবশ্যই ওয়াটারপ্রুফ সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
এমনকি যদি সাগরের পানিতে নামতে চান অথবা সুইমিংপুলে গোসল করতে চান, তাহলেও ওয়াটারপ্রুফ সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
না হলে পানি এবং ঘামের সঙ্গে সানস্ক্রিন উঠে যাবে।
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য লোশন ব্যবহার করতে পারেন। অতিরিক্ত তৈলাক্ত ত্বক যাদের তারা অয়েল ফ্রি লোশন অথবা সানব্লক পাউডার ব্যবহার করতে পারেন।
সরাসরি সানস্ক্রিন মাখবেন না। সানস্ক্রিন মাখার আগে অল্প করে ময়েশ্চারাইজার মেখে নিন। এতে ত্বকে আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
সানস্ক্রিন ব্যবহারের উপকারিতা
আসুনে জেনে নিই কেন আমরা এতো করে সানস্ক্রিন ব্যবহারের উপর জোর দিচ্ছি।
অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা
সূর্যরশ্মি শরীরের ভিটামিন ডি তৈরিতে করতে সহায়তা করে। তবে বেশি সময় রোদে থাকা ত্বক ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সানস্ক্রিন সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করতে পারে।
বয়সের ছাপ দূর করে
সবাই চায় তারুণ্যময়, উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর ত্বক ধরে রাখতে।
অনেক গবেষণায় দাবী করা হয়, ৫৫ বছর বয়সের নিচের যারা নিয়মিত সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করে তাদের ত্বকের বয়সের ছাপ পড়ার সমস্যা শতকরা ২৪ শতাংশ কমে যায়।
ত্বকের ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস
অতিবেগুনি রশ্মির জন্য ত্বকের সুরক্ষার স্তর পাতলা হতে থাকে।
ফলে ত্বকে নানা রকমের ক্ষতি যেমন- ক্যান্সার বিশেষত, ‘মেলানোমা’ দেখা দেয়। নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহারে ত্বক সুরক্ষিত থাকে এবং ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে।
রোদে পোড়া থেকে রক্ষা করে
রোদে থাকার ফলে ত্বকে পোড়াভাব দেখা দেওয়ার পাশাপাশি ফুস্কুরি, লালচেভাব, চুলকানিও হতে পারে। এগুলো থেকে রক্ষা দিতে পারে সানস্ক্রিন।
তাই, ত্বকের যত্নে নিয়মিত সঠিক সানস্ক্রিনটি ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।