Search
Close this search box.

ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ ও চিকিৎসা

বিভিন্ন সমীক্ষার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন যে ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুত হারে।

কিন্তু জানেন কী, শুধু সচেতনতা থাকলেই একেবারে প্রথমদিকে রোগ ধরা পড়বে এবং সেক্ষেত্রে চিকিৎসায় সাফল্য মেলার হারও বেশি হয়।

বিশেষ করে যদি আপনার পরিবারে কারও ব্রেস্ট ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, আর্থাৎ মা, বোন বা রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়া যদি ৪০ এর কম বয়সেই স্তনের ক্যানসারে আক্রান্ত হন বা ৬০ বছরের আগেই গর্ভাশয়ের ক্যানসার ধরা পড়ে থাকে, তা হলে ৩০ বছরের পর থেকেই ডাক্তার দেখাতে হবে নিয়মিত।

জেনেটিক কাউন্সেলিং ও জেনেটিক টেস্ট করানো দরকার।

ব্রেস্ট ক্যান্সার কেন হয়?

স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়।

সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার।

প্রথমত এর জন্য দায়ী আমাদের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন। যেমন আজকাল আমরা প্রচুর ফাস্ট ফুড খাই, সবুজ শাকসবজি খুবই কম খাই, কম শারীরিক পরিশ্রম করি।

যার ফলে আমরা অতিরিক্ত স্থূলতায় ভুগছি। অতিরিক্ত স্থূলতা, দেরিতে সন্তান নেয়া ও শিশুকে বুকের দুধ দিতে অনীহা বা অপারগতা এর অন্যতম প্রধান কারণ।

স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে যেসব মায়েরা সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ান না, তাদের স্তন ক্যানসারে ঝুঁকি বেশি।

কারা স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন?

বয়স্ক নারী, যাদের স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস আছে, যেসব নারীরা সন্তানকে বুকের দুধ পান করাননি BRCA-1, BRCA-2 নামক জিনের মিউটেশনের কারণে, অল্প বয়সে মাসিক শুরু হওয়া, দেরিতে মাসিক বন্ধ হওয়া, মদ্যপান করলে,স্তনের কিছু অসুখ যেমন atypical ductal বা lobular hyperplasia থাকলে। এছাড়া অন্য কোনো ক্যান্সার যেমন- কোলন, ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হলে।

প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগী ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়।

ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ

  • ব্রেস্টে চাকা ও লাম্প বা পিন্ড অনুভব করা; যা ব্যথাহীন ও খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে আকারে।
  • ব্রেস্টের ত্বকে বিভিন্ন পরিবর্তন যেমন চামড়া কুঁচকে যাওয়া, কমলার খোসার মত ছোট ছোট ছিদ্র দেখা দেয়া, চামড়ায় টোল পড়া, দীর্ঘস্থায়ী ঘা ইত্যাদি।
  • নিপল (বোঁটা) দিয়ে রস নিঃসরণ হওয়া বা রক্তপাত হওয়া।
  • নিপল ও তার আশেপাশের কালো অংশা ফুঁসকুড়ি ও চুলকানি হওয়া।
  • ব্রেস্টে দীর্ঘদিন ব্যথা অনুভূত হওয়া।
  • ব্রেস্টের আকার পরিবর্তন হওয়া।
  • গলার কাছে অথবা বগলে চাকা অনুভব করা।
  • নিপল ভেতরের দিকে ঢুকে যাওয়া অথবা বোটা দিয়ে পুঁজ নির্গত হওয়া।

ব্রেস্ট ক্যান্সার পরীক্ষা পদ্ধতি

২০ বছর বয়স থেকেই প্রত্যেকের উচিত স্তন ক্যান্সার বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে নিজের স্তন পরীক্ষা করা।

মাসিক শুরুর ৫-৭ দিন পর এই পরীক্ষা করতে হবে যখন স্তন নরম ও কম ব্যথা থাকে।

  • শুয়ে বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের স্তনকে চারটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি অংশের অভ্যন্তরে কোন চাকা বা দলার মতো আছে কিনা তা অনুভব করুন।
  • স্তনের আকৃতির বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা দেখুন।
  • সাধারণত দুই স্তনের আকার এক রকম নাও হতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। তাই চিন্তার কিছু নেই।
  • নিপল থেকে অকারণে কোন তরল রস বের হয় কিনা তা লক্ষ্য করুন। তবে প্রসব পূর্ববর্তী বা প্রসব পরবর্তী নিঃসরণকে এর সাথে মিলিয়ে ফেলা চলবে না।
  • বগলে কিংবা ঘাড়ে কোন চাকা অনুভব করতে পারছেন কিনা লক্ষ্য করুন।
  • আপনার বাম হাত দিয়ে ডান পাশের ও ডান হাত দিয়ে বাম পাশের স্তন পরীক্ষা করুন।

এই পরীক্ষা করার সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখবেন যাতে আপনার সম্পূর্ণ স্তনটি পরীক্ষা করা হয়।

এক্ষেত্রে আপনি নিপল থেকে শুরু করে বৃত্তাকারভাবে বাহিরের দিকে যেতে পারেন অথবা উপর-নিচ করে সম্পূর্ণ স্তন পরীক্ষা করতে পারেন।

লক্ষ্য রাখবেন যাতে আপনি সকল টিস্যু (চামড়া থেকে স্তনের নিচের বুকের খাঁচা পর্যন্ত) অনুভব করেছেন।

চামড়া ও চামড়ার অল্প নিচের অংশের জন্য অল্প চাপ দিন, স্তনের মাঝের অংশের জন্য মাঝারি চাপ দিন ও স্তনের নিচের অংশ অনুভবের জন্য গভীরভাবে চাপ দিন।

ব্রেস্ট ক্যান্সার নিশ্চিত হওয়ার উপায়

সাধারনত তিনটি উপায়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায়।

  • উপরে উল্লেখিত পরীক্ষার মাধ্যমে।
  • ম্যামোগ্রাফি বা স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম করে।
  • বায়োপসি অথবা এফএনএসি (FNAC) করে।

জেনেটিক অ্যানালিসিস পজিটিভ হলে সার্জেন ম্যাসটেকটোমি করিয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আর ‘গেইলস ক্রাইটেরিয়া’ অনুযায়ী যাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির হার বেশি, তাদের সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। জানাচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

সেই সঙ্গে অল্প বয়স থেকেই শুরু করুন ক্লিনিকাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন।

বেশিরভাগ অল্পবয়সি, শিক্ষিত, শহুরে মহিলা ভাবতেই পারেন না যে এই মারণ রোগ যে কোনও মুহূর্তে হানা দিতে পারে।

তাদের ধারণা ভালো খাওয়াদাওয়া-ব্যায়াম করলেই বুঝি ক্যানসার থেকে দূরে থাকা যায়।

তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে নানা ভুল ধারণা।

অনেকেই ভাবেন বায়োপসি বা FNAC করালে ক্যানসার আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই চিকিৎসা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে যায়।

মনে রাখবেন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিটি দিন অত্যন্ত জরুরি। প্রথমদিকে রোগ নির্ণয় হলে পুরোপুরি সেরে ওঠাও সহজ হয়।

যদি দেখেন যে আপনার স্তনের আকারে পরিবর্তন আসছে, অস্বাভাবিক ক্ষরণ হচ্ছে, বগলের নিচে ফোলাভাব দেখা যাচ্ছে, তা হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন তখনই।

ব্রেস্ট ক্যান্সার ৯৯.৫% ক্ষেত্রে মহিলাদের হয় বটে, বাকি রইল ০.৫%। যত ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগী আছে তার মধ্যে ০.৫% পুরুষ।

অনেক পুরুষের একটি বা দুইটি ব্রেস্ট স্বাভাবিকের তুলনায় বড় হতে পারে। এমন হলে ভালো সার্জারি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্যার নাম গাইনাকোম্যাসিয়া। তবে সকল ক্ষেত্রেই চিকিৎসার পর নিয়মিত নির্দিষ্ট সময় পর পর ফলোআপ করতে হয়।

ডায়াগনোসিস বা শনাক্তকরণ পরীক্ষা

প্রথমেই বিশেষজ্ঞরা রোগীর রোগের ইতিহাস নিয়ে থাকেন। শারীরিক পরীক্ষা করেন।

বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ব্রেস্ট ক্যানসার শনাক্ত করা হয়। রোগীর বয়সের সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখেই বিশেষজ্ঞরা তা দিয়ে থাকেন। যেমন-

  • ম্যামোগ্রাফি
  • আলট্রাসনোগ্রাফি
  • এমআরআই
  • FNAC – চাকা থেকে
  • বায়োপসি/মাংস পরীক্ষা

চিকিৎসা

প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ রোগী সুস্থ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন। এ ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রধানত কয়েক ভাগে বিভক্ত।

  • সার্জারি
  • কেমোথেরাপি
  • রেডিওথেরাপি
  • হরমোন থেরাপি
  • টার্গেটেড থেরাপি

সার্জারি 

স্তন ক্যান্সারর যে কোনো পর্যায়েই রোগীর সার্জারি করা প্রয়োজন হতে পারে। সার্জারি করা যাবে কিনা বা কী ধরনের সার্জারি হবে তাই প্রাথমিক বিবেচ্য বিষয়।

সিদ্ধান্ত নেবেন সার্জন এবং ক্যানসার বিশেষজ্ঞ দুজনে মিলে। অনেক সময় শুধু টিউমার কেটে ফেলা হয়। অনেক সময় পুরো বেস্টই ফেলে দেয়া হয়।

কেমোথেরাপি 

প্রায় সব ক্যান্সার রোগীকেই কেমোথেরাপি নিতে হয়। সার্জারির আগে বা পরে এমনকি রোগ শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে পড়লেও কেমোথেরাপি কাজ করে।

যদিও কেমোথেরাপিতে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তবুও রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য কেমোথেরাপির বিকল্প নেই।

রোগীর শারীরিক অবস্থা, কেমোথেরাপির কার্যকারিতা, রোগীর আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়েই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত পরামর্শ দেন।

কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাতে কম হয় তারও ব্যবস্থাপত্র দেন চিকিৎসকরা।

রেডিওথেরাপি 

বিশেষ ধরনের মেশিনের মাধ্যমে রোগীদের রেডিওথেরাপি চিকিৎসা দেয়া হয়।

এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সাধারণ কেমোথেরাপির পরই রেডিওথেরাপি দেয়া হয়।

রেডিওথেরাপি দিয়ে হাড়ের ভাঙন বা ফ্র্যাকচার রোধ করা যায়।

হরমোন থেরাপি 

সব ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীর জন্য হরমোনের দরকার নেই। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই হরমোনের চিকিৎসা কাদের লাগবে তা শনাক্ত করেন।

টার্গেটেড থেরাপি

এ থেরাপি রোগীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। যেমন- Transtyuumab, Lapatinib, Bevacizumab ইত্যাদি।

করণীয়

ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং জরুরি।

ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে সবারই জানা উচিত এবং এই প্রোগ্রাম এর আওতায় আসা উচিত।

তাহলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়বে এবং রোগী দ্রুত সুস্থ হবে। 

আমাদের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রা এবং জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন হলে (যা ক্যান্সার রোগের কারণ) এ রোগের প্রকোপ অনেকাংশেই কমে আসবে এবং আমাদের সমাজে সুস্থ-সুন্দর জীবনের অধিকারী মানুষের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।

তো এখন জেনে নেওয়া গেলো ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যাবতীয় তথ্যাদি।

আশা করছি আমরা নারীরা নিজেরা সচেতন হবো এবং অন্য সবাইকেও সচেতন করবো।

কারণ একটু সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে নারীদের নিরাপদ রাখতে। পারে অকাল মৃত্যু ঠেকাতে।