Search
Close this search box.

ডিভোর্স: সম্পর্কের সৌন্দর্য নাকি তিক্ততা? (পর্ব-২)

আমাদের সমাজে সংখ্যায় বাড়তে থাকা এই ম্যাসিভ ডিভোর্স রেটের কারণ কী?

আমরা চেস্টা করেছি এর কারণগুলো খুঁজে বের করতে।

চার পর্বের ধারাবাহিক এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব রইলো আজ।

প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে

দুই পরিবারের অভিভাবকদের অনুপ্রবেশ

ধর্মমতেই ধরা যায়, কী মানবতা বা শিক্ষার আলোকে, স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত ছোটখাট বিষয়ে যখনই দুই পক্ষের বাবা মা এসেছে, বা অন্যরা এসেছে, তখনই ভাঙন ধরতে বেশি সময় লাগেনি।

এক্ষেত্রে অনেকেই গালমন্দ করে দায়ী করতে চান, মেয়ের মাকে।

কিন্তু করা তেতো হলেও সত্য,এখন পর্যন্ত ৯৫% মা কখনও চান না মেয়ের সংসার ভাঙুক।

তারা মেয়ের সংসারে তখনই ইনভল্ভ হন নিজে, যখন দেখেন শ্বশুরবাড়ির ইন্টাফেয়ারেন্সে মেয়ের দম ফেলার অবস্থা নেই, অথচ সেই মেয়েকে সাপোর্ট করতে পাশে নেই, তার স্বামীও!

এদিকে এদেশের আরেকটা সনাতনী নিয়ম, ছেলের মা বাবা যেটাই বলুক, গায়ে সয়ে নেয়া শিখতে হবে মেয়ে এবং মেয়ে বাড়ির।

হৈমন্তী গল্পটার কথা মনে আছে> মেয়েটা মারাই যায় এসব নোংরামীতে।

রবীন্দ্রনাথ ১০০ বছর আগে হৈমন্তীর গল্প লিখে গেলেও, তা আজও ঘটে চলেছে এসেছে আনাচে কানাচেতে।

অন্যদিকে, মেয়ের বাড়ি থেকে একটা কথাও যদি আসে, যতটা না পুরুষের ইগোতে আঘাত করে, তার থেকে বেশি আঘাত করে ছেলে বাবা মায়ের ইগোতে।

ছেলে জন্ম দিয়েছেন কি এসব কথা শুনতে! ব্যাস।

শুরু হলে যায় হাজার বছর ধরে আসা নোংরা পলিটিক্স- কান পচানি, কথার মারপ্যাচ। অতঃপর হয় মেয়ে মাথা নত কর, নয় তালাক!

মেয়েরা কেন এ অন্যায় মেনে নিবে?

একা বেঁচে থাকতে পারে নারী, তাও এই অপমান মাথায় নিয়ে নয়। অতঃপর ডিভোর্স।

তবে সকল ক্ষেত্রে যে ছেলের বাবা মা-ই দায়ী থাকে, তা নয়।

কিছু ব্যতিক্রমী জায়গায় মেয়ে কিংবা মেয়ের সাথে মেয়ের অভিভাবকেরাও দায়ী থাকে সংসার ভাঙতে।

নানা ভাবে ইন্ধন দেয় ডিভোর্সের। তবে ব্যতিক্রম তো কখনও উদাহরণ হতে পারে না, তাই না?

কম সংখ্যক সন্তান হওয়া

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ার পিছে এই শতাব্দীর বেশ একটা জোড়ালো কারণ কিন্তু কম-সংখ্যক সন্তান।

পরিবার-পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গত ৩০ বছরের একটা মারাত্মক অর্জন বলতে পারেন এই জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা।

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে, যেখানে এই প্রবৃদ্ধি হার ছিল ৫% এর উপর, সেখানে গত ২০২০ সালের পরিসংখ্য্যান তথ্যমতে এই হার এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৩%!

আর শুধুমাত্র খাতা-কলমেই নয়, বাস্তবেও এর প্রমাণ আশেপাশের দেখা যাচ্ছে।

সমাজের নিম্নবিত্ত একজন ক্লার্কের পরিবার থেকে শুরু করে, উচ্চবিত্তের বিশাল ব্যবসায়ী, ২টি সন্তানের বেশি খুব একটা দেখা যায় না।

এমন কি দুই সন্তান মেয়ে হলেও, ছেলে সন্তানের আশায় ৩য় সন্তান ধারণের কেইসও আমাদের সমাজ থেকে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

দুই এর অধিক সন্তান এখন শুধুই দেখা যায় বলতে গেলে, গ্রামীণ কিছু পরিবারে, যেখানে পরিপূর্ণ শিক্ষা, দূরদর্শিতা এবং সঠিক ধর্মের শিক্ষা এখনও পৌঁছায়নি।

ধর্মান্ধতা আর প্রাচীন অর্থনৈতিক বিশ্বাসকে পুঁজি করেই সেই ব্যতিক্রমী পরিবারগুলো দুই এর অধিক সন্তান ধারণ করছে, তবে আশার করা হল সে সংখ্যাও কমে আসছে ক্রমান্বয়ে, কারণ কম সন্তান থাকার সুবিধাগুলো তারাও বোঝা শুরু করেছেন।

কেন এতক্ষণ এই কম সংখ্যার ব্যাপারটা তুলে ধরা হল? ডিভোর্স রেইট বৃদ্ধির সাথে এর ভূমিকা কী?

কম সন্তান ধারণ- ডিভোর্স রেইট বৃদ্ধির পিছনে প্রধানত ৩ টা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।

এর মধ্যে প্রথম দুটি হল, দম্পত্তির অভিভাবক পরিবারের ক্ষেত্রে এবং একটি ডিভোর্সী দম্পত্তির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।

অর্থনৈতিক কারণ

আগেরকাল আমলে প্রতিটা পরিবারেই কমপক্ষে সন্তান সংখ্যা থাকতো ৫ টি। সাধারণট ১০-১২টা করে সন্তানও দেখা যেতো।

মুক্তিযুদ্ধের পরেও, খুব কম পরিবার আছে, যারা ৫ সন্তানের নিচে পরিবারের সদস্য ধারণ করতো।

এর একটা মারাত্মক প্রভাব ঐ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর পরে।

বেশি সংখ্যক সন্তান মানে, বেশি সংখ্যক মুখ, তাতে বেশি সংখ্যক খাবার দেয়া।

তাদের জন্য বেশি সংখ্যক লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা, বেশি সংখ্যক জামা কাপড় দেয়া থেকে শুরু করে শেষ বয়সে সম্পত্তি বন্টনেও বেশি সংখ্যক ভাগিদার হওয়া।

অর্থাৎ, সে আমলেও বাবা মায়ের মিলিত সম্পদের পরিমাণ মোটামুটি হলেও, এত পরিমাণ বাচ্চার মধ্যে, প্রত্যেকটা বাচ্চাকে মানুষ করা, তাদের বিয়ে দেয়া, সম্পদ দেয়া- এসব করতে করতে, ইন্ডিভিড্যুয়ালি প্রত্যেকের সম্পদের পরিমাণ হতো হতাশাজনকভাবে কম।

খুব বেশি উচ্চবিত্ত না হলে, দিনশেষে তেমন কিছু হাতে থাকতো না কারো

অন্যদিকে, বর্তমানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একটা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরও যদি ২ টা সন্তান থাকে, তাহলে তাদের লালন পালন এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় খুব কম খরচ হচ্ছে।

খরচ শেষেও শেষ বয়সে নিজের হাতে বেশ কিছু সঞ্চয় থাকছে, তার সাথে বাবা এবং মায়ের বাড়ির থেকে প্রাপ্ত ওয়ারিশ সম্পত্তি মিলিয়ে অবস্থা খুব একটা খারাপ নেই।

আর আলোচনার শুরুতেই বলা হয়ছিল,অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খুব খুব বড় একটা রোল প্লে করে ডিভোর্সের ব্যাপারে। কিভাবে জানেন?

ধরুন, ঐ ক্লার্কেরই শুধু ২ টাই মেয়ে। এবং তাদের মধ্যে একজনের সংসারে পূর্বের উল্লেখিত কারণগুলোর জন্য নানা রকম অশান্তি হচ্ছে।

যেয়েতু, দুইটাই মেয়ে, বাবা মা পরিপূর্ণ যত্নে তাদের পূর্ণ শিক্ষিত, অন্তত ডিগ্রী কলেজ থেকে গ্রাডুয়েট করিয়েছে।

মেয়েটার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক প্রসারিত হয়েছে। সে আর শ্বশুর-বাড়ির এই আদি সংস্কৃতি আর বিকৃত ধর্মচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া নির্যাতন আর একপেশে মানিয়ে চলার বোঝার নিতে রাজী হচ্ছে না।

এর ফলে শুরু হচ্ছে, সেই মেয়ের প্রতি স্বামী আর গোড়া শ্বশুরবাড়ির সেই অকথ্য মানসিক আর শারীরিক এবিউজিং।

মেয়ের বাবা মায়ের কাছে এই ঘটনা যখনই পৌঁছাচ্ছে, যদিও প্রথম ১-২ বছর সহ্য করতে বা এডজাস্ট করতে বলছে, কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে মেয়েকে নিজের কাছে।

অর্থনৈতিক ব্যাক-আপ ভালো হওয়ায়, বাবা মায়ের আর চিন্তা করা লাগছে না, মেয়েকে ঘরে আনলে কি খাওয়াবে। মেয়েও শিক্ষিত গ্রাডুয়েট।

ব্যাস, বাবা মায়ের সাপোর্টেই অত্যাচারের থেকে বের হয়ে মেয়েরা ডিভোর্স নিয়ে মুক্তি পাচ্ছে এই অস্বাভাবিক নির্যাতন থেকে।

মানসিক-যোগাযোগ

এ ব্যাপারটা খালি মানুষের ক্ষেত্রে নয়, সংখ্যয় যখন কোন জিনিসও কম হয়, অটোমেটিক সে জিনিসের কদর বাড়ে, সে জিনিসের প্রতি আলাদা একটা মানসিক কানেকশন তৈরি হয়।

আগেকার আমলের উদাহরণে আবারো যেতে হচ্ছে।

১০-১২ টা বাচ্চার মধ্যে ২-১ জন অসুখে বা বিভিন্ন এক্সিডেন্টে মারা গেলেও, মা বাবার মানসিক হাহাকার অতটা থাকার সুযোগও হতো না, বাকি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনের চাপে।

একইভাবে, সে সময়ে কোন মেয়ের সংসারে অশান্তি হলেও, খুব কম সংখ্যক বাবা মা সেটায় প্রত্যক্ষভাবে ইন্টারফেয়ার করতো।

মেয়েটা বেঁচে থাকলেও, জীবন্ত লাশের মতো সংসার দেখছে- তা জেনে বুঝেও বাবা মা চুপ থাকতো, যেহেতু এত সন্তানের মধ্যে মেয়েটার সাথে ঐ এটাচমেন্টটা হয়ই নাই।

মেয়েটার কপাল খারাপ- এটা মেনেই চুপ চাপ থাকতো

কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। মাত্র ২-১ টা সন্তান। প্রচন্ড আদরে, অনেক স্বপ্নঘিরে মানুষ করেছেন বাবা মা।

সেই আদরের মেয়েটার কপালে এই দুঃখ, এই নির্যাতন, তার উপর হওয়া এই অন্যায় এখন খুব কম বাবা মা-ই সহ্য করতে পারে।

কারণ সন্তান সংখ্যা কম হওয়ায়, দীর্ঘসময় ঐ একটা নির্দিষ্ট বাচ্চার সাথেই আগের আমলের তুলনায় অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে বাবা মা।

দীর্ঘ সময় ঘনিষ্ট থাকায়,মেন্টাল ব্রীজ বা কানেকশন হচ্ছে আরও শক্তপোক্তভাবে।

ফলে আদরের বাচ্চাটার এই কান্না, এই কষ্ট! অসম্ভব সহ্য করা যে কোন বাবা মায়ের পক্ষে। এরফলে কিছু উল্লেখযোগ্য ইন্সিডেন্সের পরেও মেয়েকে নিয়ে আসছে।

অর্থনৈতিক সক্ষমতা থাকার পাশাপাশি এই মানসিক আবেগীয় এটাচমেন্টের ফলেই বাবা মা সাহস করে এখন বসছে ছেলে পক্ষের সাথে বার্গেনিং এ।

জবাব চাইছে তাদের মেয়ের প্রতি করা এই অবিচারের।

ফলস্বরূপ, আমরা ছেলেপক্ষ, সব পারি- এই উপমহাদেশের তথাকথিত আদি ধারণার লালনকারী ছেলেপক্ষের ইগোতে লাগছে আঘাত।

মেয়ের বাবা-মাও কম না, এবং আদর্শগতভাবে তারা সঠিক। সুতরাং, একইতাই পরিণতি- ডিভোর্স।

দম্পত্তির পিছুটান আর দায়িত্বের পরিমাণ কমে যাওয়া

আগেকার আমলের দম্পত্তিদের সন্তান সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অত্যাধিক হওয়ায়, বাচ্চাগুলো বয়সসীমা হতো বিভিন্ন লেভেলের।

একই সময়ে, ঐ ঘরে কলেজ পড়ুয়া ম্যাচিউর্ড সন্তানও যেমন থাকতো, তেমনি অবুঝ-জিদ করা ২-৩ বছরের সন্তানও থাকতো।

এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব বেশি অমিল দেখা গেলেও, বাচ্চাগুলোর মানসিক অবস্থা,আবেগ এবং তাদের লালন পালনের জন্য দরকারী বিশাল খরচের দিকটা চিন্তা করেই, পরস্পরকে অপছন্দ করা সত্ত্বেও সংসারে টিকে যেত।

আর মায়েরা যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাউজ-ওয়াইফ থাকতেন; ডিভোর্স হলে০ তার হাতে দুইটা অপশন থাকতো- হয় বাচ্চাদের ফেলে চলে যেতে হবে বাবা-বাড়ি, নয় সব সন্তানদের নিজের দায়িত্বে পালন করতে হবে।

কেননা, বাংলাদেশের আইনী ফাঁকফোকর প্রয়োগ করে, সেই বাবা ঠিকই সন্তানের খরচ দেয়া থেকে নিজেকে মুক্তি করে নিত ডিভোর্সের পরে।

একজন হাউজ ওয়াইফ মায়ের পক্ষে এই ৪-৫ টা সন্তান বড় করার মতো সাহস, সুযোগ খুব কমই থাকতো সে আমলে।

ফলে শত অত্যাচার মায়ের উপর হলেও, শুধুমাত্র সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, মা গায়ে সয়ে নিত সব, সংসারটা টিকিয়ে রাখতো।

এমন অনেক রেফারেন্স কেইসও আছে, ঘরে স্বামী দ্বিতীয় মেয়েকে নিয়ে উঠে অশ্লীলতা করলেও, মা সন্তানদের বুকে নিয়ে পাশের রুমে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতেন, শুধুমাত্র সেই সন্তানদের একটা অভাবহীন সুন্দর জীবণ দেয়ার উদ্দেশ্যে।

কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন, আধুনিক দম্পত্তিরা তো এখন দুইটা সন্তানও নিতে চায় না

একটাই তাদের কাছে যথেষ্ট, এরপর তারা ক্যারিয়ারে মন দেয়।

এর ফলে বাচ্চাটা ১০-১২ বছরের মধ্যেই যথেষ্ট ম্যাচিউর্ড হয়ে যাচ্ছে।

আশেপাশে ঘটে যাওয়া এত্ত ডিভোর্স দেখতে দেখতে তার কাছেও ব্যাপারটা একদম সহজ হয়ে যাচ্ছে।

তার উপর, বাবা মা –দুইজনই সক্ষম, ক্যারিয়ার কন্সাস বিধায়।

বাবা মায়ের সম্পত্তির ব্যাক-আপে প্রত্যেকটা স্বামী স্ত্রী সক্ষম, অন্তত ১টা বাচ্চাকে লালন করতে।

ফলস্বরূপ এই যুগের মেয়েদের উপর কোন বাধ্যবাধকতা নাই. সব অত্যাচার সহ্য করে হলেও, স্বামীর অনৈতিক কর্মকান্ড প্রমাণিত হওয়ার পরেও দাঁতে দাঁত চেপে, শুধুমাত্র সন্তানকে মানুষের করার জন্য সংসারে পড়ে থাকবে।

অতঃপর, মিউচুয়াল ডিসিশনে সন্দর করে একটা ডিভোর্স।

পরবর্তী পর্বে চলবে…

তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে