Search
Close this search box.

ফারজানা লিও: যিনি সৌন্দর্য ছড়িয়েছেন অন্যভাবে

একজন নারীর সৌন্দর্য শুধুমাত্র তার চামড়া আর সাজসজ্জার মধ্যে নয়, আসল নারীর সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে তার কর্মস্পৃহা, তার দৃষ্টিভঙ্গি আর তার কর্মের মধ্যে।

একবিংশ শতাব্দীর নারীরা এ ব্যাপারে আরও সচেতন।

তাই জন্মগত দৈহিক প্রতিফলন নয়, বরং তার কাজে, তার চারপাশের পরিবেশে নিজের ভূমিকাকে অটুট রেখে ছড়িয়ে দেয় তার ইনার বিউটিকে।

মোহিত করে আশেপাশের সমস্ত অস্তিত্বকে।

একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি…

একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এই মানব সমাজটাকে কিভাবে চিন্তা করি? জটিল হলো কি প্রশ্নটা?

তাহলে বরং সহজভাবে চিন্তা করতে একটু স্কুল জীবনে ফিরে যাই-

সমাজ কাকে বলে? – সমাজ বলতে আমরা যেখানে বাস করি সে স্থান এবং তার আশেপাশের সমগ্র পরিবেশকে বলে।

এবার প্রশ্নটা আরেক ধাপ এগিয়ে যদি করা হয়- কাদের নিয়ে এ সমাজ গঠিত? প্রশ্নটা পড়ে নিশ্চয় মুচকি হেসে ভাবছেন, এসব কী প্রশ্ন!

অবশ্যই বাবা-মা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু, শত্রু, চারপাশের পরিবেশ নিয়ে সমাজ তৈরি।

এটাই যদি ভেবে থাকেন, তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি ভুল।

সমাজ কি শুধু মানুষদের নিয়েই?

কারণ সমাজে মানুষ অবশ্যই একটা “এলিমেন্টস” কিন্তু মানুষ একারাই এই সমাজ গঠনে সর্বত্র ভূমিকা রাখছে না।

কি, ভড়কে গেলেন? বেশ একটু বারান্দায় যান তো, রাস্তাটা দেখতে পারছেন?

ওখানে কোন কুকুর, বিড়াল বা অন্য কিছু দেখছেন? শহরে অবশ্য নরমাল রাস্তাঘাটে আর যা-ই হোক, কোরবানি বাদে কেউ গরু-ছাগলদের এক্সপেক্ট করেও না।

আচ্ছা , রাস্তায় কিছু না পান, একটু আকাশ, নিজের বাড়ির সিলিং কিংবা গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন তো, কান পেতে শোনার চেষ্টা করুন তো!

কি, এবার পারলেন তো? পাখিদের কিচিরমিচির কিংবা না হয় ঐ বোকা কাকটারই একা একা বিকট কা কা আওয়াজ!

জি, হ্যা। মানুষজাতটা এখন যে সমাজে বাস করে, সেখানের অংশ ওরাও- এই পাখি, কাক, গরু ছাগল, কুকুর, বিড়াল কিংবা অন্য জীবও।

এমনকি গাছও এই সমাজেরই একটা বিশেষ অংশ।

কালের বিবর্তন

এই একবিংশ শতাব্দীর বর্ধিত সমাজে তো এদের সমাজের অংশ মানানো রীতিমতো একটা দায়িত্ব! কেন বললাম?

বেশি দূরে না যাই, ধরুন এই মিরপুর কিংবা ঢাকার গুলশান, বা এয়ারপোর্টের অদূরে থাকা উত্তরা-

আজ থেকে ৪০ বছর আগেও কি ঠিক এরকম উচু উচু বিল্ডিং এর রাজ্য ছিলো?

উত্তরটা হলো- আজ থেকে ২০ বছর আগেও মিরপুর ছিল গাছে ঢাকা এক অনাবিল পরিবেশ, যে গাছে গাছে বাসা বাধতো রঙ বেরঙের টিয়া, শালিক, চড়ুই কত কী!

নিচে জমিনে থাকতো শেয়াল, বনকুকুর।

মিরপুরে তো শেয়ালবাড়ি নামের জায়গাটা আছে আজও!

উত্তরা, গুলশানও ছিল বনে ভরা এক অভয়ারাণ্য ওদের জন্য।

কিন্তু কালক্রমে জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে, মানুষের বসতির জন্য ওদের আবাস শেষ হয়ে যায়।

ঘরহারা অবলাগুলো বাধ্য হয়ে এই লোকালোকেই ডাস্টবিন, বা কোন গলির কোণায় থাকা শুরু করে।

তাই কর্মের দিক থেকেই হোক, কিংবা ক্ষতিপূরণের দিক থেকে–

ওদের আবাস দখল করা এই মানুষকে আজ না চাইলেও মেনে নিতে হবে, যে আমাদের সমাজটায় এখন মেইন এলিমেন্ট শুধু মানুষ নই।

বরং মানুষের সাথে এই এলাকাগুলোয় বাস করা আদি-জীবরাও এখন আমাদের সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ।

মানব সমাজ সম্পর্কে ঠিক এরকমই এক ব্যতিক্রমী ধারণা নিয়ে গত প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর কাজ করে যাচ্ছেন ঐ অবলাদের এক মা।

একজন মানবী-যে মাদার নেচারের কাছে আমাদের গর্বিতভাবে মাথা উঁচু করে চলতে একটা মাত্রা যোগ করেছেন- ফারজানা লিও।

নব্বই দশকের শুরুর দিকে ঢাকায় জন্ম ফারজানা লিওর।

পুরো জীবনের বেশ একটা অংশজুড়েই আছে এই নতুন করে সমাজকে সাজানোর কাজ আর নানা মিষ্টি-তেতো অভিজ্ঞতা।

গ্ল্যামোজেন এই ব্যতিক্রমী সমাজ তৈরীর কারিগরকে নিয়েই পসরা সাজিয়েছে আজকের এই আয়োজনে।

এনিমেল ওয়েলফেয়ারে অংশগ্রহণ, হাতে-খড়ি এবং অনুপ্রেরণা

ঠিক কবে থেকে এই পশুপাখিদের নিয়ে জড়িয়ে পড়লেন, কিংবা হাতে-খড়িটা কার থেকে হলো?

এরকম ব্যতিক্রমী কাজের অনুপ্রেরণাটাই বা কোথা থেকে প্রথম এসেছিলো- গ্ল্যামোজেনের এই প্রশ্নের জবাবে বেশ নস্টালজিক হয়ে গেলেন ফারজানা।

তারই বয়ানে জানা হলো- “একদম ছোট থেকেই দেখতাম, আমাদের বাসা ভর্তি নানা ধরণের পাখি থাকতো।

নানিয়া, মুনিয়া, টুনটুনি, নানা প্রজাতের টিয়াদের বাবা সারা দিন রাতই খাওয়াতেন, দেখাশোনা করতেন।

এমনকি আমাদের বাসায় , আগেকার আমলের ডিজাইনে ভেন্টিলেটর ছিল।

সেখানেও এমনভাবে খড় দিয়ে স্পেস করা থাকতো, যেন চড়ুইরা নিশ্চিন্তে বাসা বেঁধে সংসার পাততে পারে।

ওখান থেকেই প্রথম পশুপাখিদের কাছে আসা।

পরবর্তীতে যখন একটু বুঝ হলো, দেখতাম- দাদাবাড়িতেও সবসময় একদল কুকুর পোষা থাকতোই।

তাদের খাওয়া দাওয়াও দাদুরা দেখতেন। ওসব দেখতে দেখতেই কখন অবচেতন মনেই ওদের সাথে একটা এটাচমেন্ট চলে আসে।”

প্রথম পোষার চেষ্টা? – ব্যাপারে প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করার আগেই ফারজানা বলে উঠলেন-

“স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তা থেকে এনেছিলাম মা-হারা এক দেড় মাসের বিড়ালছানাকে, পুশি নাম। নতুন ছিলাম, নার্সিং অত বুঝতাম না।

১২ বছরের আমাকে বাবাই শিখিয়েছিলেন কিভাবে পটি ট্রেনিং করাতে হয়, খাওয়াতে হয় ছোট বাচ্চাকে।

এরপর ক্লাস নাইন-টেনে ছোট নানুর কাছ থেকে রাফিয়ানকে আনি। ওটাও একটা বিড়াল ছিলো।

স্টাডি প্রেশারে এর মাঝে সেভাবে কিছু করতে পারিনি তখন। পড়তাম মনিপুরী হাই স্কুলে।

ঐ স্কুলের প্রেশারটা আসলেই অন্যরকম ছিলো। কিন্তু বরাবরই ওদের জন্য মনটা টানতো।

রাস্তায় ফেরার পথে প্রায়ই স্ট্রে এনিমেলদের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম এটা ওটা।”

তাহলে পুরোপুরি সংযুক্ত হলেন কবে থেকে? – উত্তরে বেশ লাজুক হাসি দিয়ে ফারজানা বললেন-

“প্রথম পারমানেন্টলি মেন্টালি ইনভল্ভ হই ২০১১ সালে। আমার স্বামী (প্রাক্তন) নিয়ে আসেন জন্মদিনের উপহার হিসেবে মার্লিনকে ১৩ই সেপ্টেম্বরে।”

মার্লিন? – গ্ল্যামোজেন প্রতিনিধির জিজ্ঞাসু কন্ঠে ফারজানা নিজের থেকেই বললেন, “ও ছিলো কেশহাউন্ড (Keesh hound) ব্রিডের মিক্স একটা কুকুর।

ও-ই প্রথম কুকুর, যাকে নিজের বাড়িতে প্রথম পুষি। নিজের বাচ্চার থেকে কোন অংশে কম ছিলো না।”

পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা কিংবা বাধা

বাড়িতে প্রথম কুকুর, স্বামী এনেছিলো। নিশ্চই তাহলে খুব সুন্দর একটা ওয়েলকাম পেয়েছিল মার্লিন? – প্রশ্ন করতেই বলে উঠলেন লিও,

“উহু! বরং উলটো। প্রথম অবজেকশন শুরু করেন আমার মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি।

যদিও তারা কেউই আমাদের সাথে থাকতেন না, বরং রেজা (স্বামী) এবং আমি আলাদা বাসা নিয়েই থাকতাম।

কিন্তু এদেশের টিপিক্যাল ফ্যামিলি ট্রেডিশনে ধর্ম্ভীরু কোন পক্ষের বাবা মা-ই ব্যাপারটা সহজভাবে নেননি।

বরং বেশ বছর খানেকের বেগ পেতে হয়েছিল আমার আর রেজার, ওদের মধ্যে মার্লিনকে নিয়ে গ্রহণযোগ্যতা আনতে।

পরের দিকে ঝামেলা করে বাড়িওয়ালা, আশেপাশের প্রতিবেশী। এর জন্য কম বাড়ি বদলাইনি।

কিন্তু যেখানেই যাই না কেন, কিছুদিন পরেই মার্লিনকে নিয়ে শুরু করতো চারপাশের মানুষ ঝামেলা।

অথচ জানেন, মার্লিন ভীষণ ওয়েল ট্রেইন্ড কুকুর ছিলো।

দেড় মাসের মাথায় ওকে ট্রেইনিং শুরু করি। আমার প্রথম ট্রেইনিং এর হাতে খড়ি।

অথচ মার্লিন জাস্ট ৯ মাসের মাথাতেই এতো সুন্দর মতো চলতো!

কীভাবে পটি করতে হয়, খেতে হয়, মানুষ আসলে কীভাবে গ্রিটিংস দিতে হয়, বাসায় কীভাবে লক্ষ্মী বাবুর মতো থাকতে হয়-

সবই মার্লিন আমার বুঝে গিয়েছিলো ৭ মাসের ট্রেনিং-এই!

অথচ এতদিনের মানুষকে কেউ ট্রেইন করতে পারলো না পাশাপাশি কো-একজিস্ট করতে। কে বেশি বুনো আপু?”

প্রশ্নটা শুনেই নড়েচড়ে বসলাম। নিয়ে গেলাম অন্যদিকে আলোচনাটা।

কারণ পত্র-পত্রিকায় অবলা জীবের প্রতি মানুষের পৈশাচিক নির্যাতনের ব্যাপারটা গ্ল্যামোজেনের নজর এড়ায়নি বলেই তো সচেতনতা তৈরীতে এই আয়োজন করেছে!

প্রথম স্ট্রে এনিমেল এটাচমেন্ট আর বিগ ফাইট

প্রথম এই স্ট্রে এনিমেলদের সাথে কবে সরাসরি নিযুক্ত হলেন? – “ আসলে অফিসে যাওয়া আসার পথেই স্ট্রে ডগ ক্যাটদের খাবার দিতাম। বাসায় খাওয়া এটো ভাত, মাছের কাটা, হাড় এর সাথে ভাত মাখায়ে ওদের খেতে দিতাম।

অফিস থেকে আসার পথে রুটি, বান, বিস্কিট দেয়া হতোই প্রায়। তবে প্রথম মেন্টালি কনসার্ন হই, ২০১৫ সালে রামপুরার বাজারে ঘটা এক এনিমেল এবিউজিং এর ঘটনায়।

তখন বেশ নাড়া দেয় ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়ায়।“

হোয়াইটি নামের কুকুরটার কথা বলছেন?- প্রশ্ন করতেই কিছুটা উত্তেজিত ফারজানা বললেন, “ এক্সাক্টলি! হোয়াইটি নামের স্ট্রে ডগটাকে দুইটা ছেলে খুব ব্রুটালি টর্চার করে।

পিটিয়ে চোখ বের করে দেয়। আসলে তখনই প্রথম সোশ্যাল মিডিয়া থেকে খবর পেয়ে care for paws এর সৌরভ আর জাহিস ভাই রাতের আধারে উদ্ধার করে ওকে।

Dog lovers Bangladesh গ্রুপ থেকে আমি প্রথম হোয়াইটির ব্যাপারে পোস্ট পাই। ঐ শুরু আমার সামনে এসে কাজ করার।”

স্মৃতিরোমন্থন

এরপর?- ফারজানা লিও শুরু করলেন স্মৃতিরোমন্থন- “ রেজার কাজের সূত্রে খুলনা চলে যাই। আমার ছেলে ফারহানের বয়স এক বছর। তখনও কোন সংঘে কাজ করতাম না।

থাকতাম সোনাডাংগার সেকেন্ড ফেইজে, এলাকা হিসেবে বেশ গুছানো ছিল। সে সময়ে এলাকার ১০-১২ টা কুকুরকে আমিই খাওয়াতাম। আমার খাওয়ানো দেখে ধীরে ধীরে সবাই আমাকে চিনলো।

ইয়াং ছেলে মেয়েরাও আমার সাথে যুক্ত হলো। এমনকি মুরগীর দোকান থেকেও ওদের জন্য নিয়মিত চামড়া পাখনা পেতাম। বেশ চলে যাচ্ছিল সব মিলিয়ে। আমার হাসব্যান্ড আর ছোট্ট ফারহানও খুব ইঞ্জয় করতো এই ব্যাপারগুলো।

কিন্তু প্রথম ট্রাজেডি শুরু হলো, খুলনা সিটি করপোরেশনের ডগ কিলিং প্রজেক্ট থেকে। ২০১৬ এর ডিসেম্বরের সকাল, হঠাৎ একটা পরিচিত কুকুরের করুণ আর্তনাদ আর বাকিদের চিৎকারে দৌড়ে নামতে যাই বিল্ডিং থেকে নিচে।

ছোট বাচ্চাটাকে কোলে করে, দরজা তালা দিয়ে নামতে নামতে দেখি, আমার প্রিয় বল্টুকে ওরা মেরে ফেলেছে! কী যে পাশবিক সে দৃশ্য! বুঝাতে পারবো না। সাড়াশি দিয়ে গলা ধরে, মাথা থেঁতলে মারছিলো কুকুরগুলোকে!

আমি যেতেই তাড়াহুড়ো করে করপোরেশনের গাড়ি নিয়ে পালালো। কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। রেজার বুদ্ধিতে সোজা চলে গেলাম বাচ্চাকে নিয়েই সিটি করপোরেশনে। ওখানকার লোকেরা প্রথমে হাসাহাসি করলেও, পরে বাধ্য হয় আমার অভিযোগ নিয়ে মেয়রের সাথে কথা বলতে।

নয়ন নামের এক লোকাল ছেলেও ওখানে কুকুরদের খাওয়াতো। ওর থেকেও বেশ সাহায্য পাই এসব ব্যাপারে।

কিন্তু তার কিছুদিন পর আবার নিউমার্কেট এলাকায় ডগ কিলিং হল। ব্যাস। আর ছাড় নেই! ওখান থেকেই অফিসিয়ালি আমার লড়াই শুরু এই অবলাদের হয়ে!”

অতঃপর লড়াই

ফারজানা বলে চললেন, “২০১৬ এর ঐ ম্যাসাকারের ঘটনা পুরো বাংলাদেশের এনিমেল রেস্কিউয়ারদের নাড়িয়ে দেয়। বলতে পারেন আমাদের সবার জন্য ছিল একটা টার্নিং পয়েন্ট। এর আগে পশু অধিকার আইনের নামে একটা নামে মাত্র আইন সংবিধানে লেখা থাকলেও, কখনও প্রয়োগ করা হয়নি।

সেইবার প্রথম এনিমেল রেস্কিউয়াররা বহুদিন পর সবাই এক হয়ে প্রতিবাদ র‍্যালি করলো ঢাকায় প্রথমে। Paw Life Care এর এমিল ভাই, হাবিব, Care For Paws এর জাহদ, সৌরভ মিলে ২০১৭ তে জানুয়ারিতে ঢাকায় করলো প্রথম মানব বন্ধন।

আমি ওখানেই যোগ দিলাম। এর মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগ হচ্ছিল আমার বাকি সহযোগিদের সাথে।

তাদেরকে নিয়ে পরের দিন ALB এর হৃদি, সুমি, তৃষা আপুরা চট্টগ্রামে করলেন র‍্যালি,মানবন্ধন এই ব্রুটাল কিলিং এর বিরুদ্ধে।

সেখান থেকেই একত্রে কাজ করা শুরু করলাম সোচ্চারভাবে

শুনলাম ALB তেও বেশ কিছুদিন ছিলেন। -বলার প্রসঙ্গে ফারাজানা বললেন, “হ্যা । ২০১৭ তে খুলনায় প্রথম ওদের সাথে সংযুক্ত হই অপারেশন হেড হিসেবে।

ফাউন্ডার হৃদি আপুর উৎসাহে ২ দিনের একটা ক্যাম্পেইন করি আমরা খুলনায়।

সেই ক্যাম্পেইনে আমরা সচেতনতা থেকে শুরু করে, প্রায় ১০০ কুকুরের ভ্যাক্সিনেশন, কলার পরিয়ে দেয়া করি। হৃদি আপু অনেক স্টিকার প্রিন্ট করে নিয়ে আসেন আমাদের ক্যাম্পেইনের জন্য, যা গাড়ি আর নানা দোকানে আমরা পেস্ট করি।

ছাড়া স্বামীর সাথে আমি প্রায় ১০০০ এর মতো লিফলেট বানিয়ে বিতরণ করি সমস্ত খুলনা শহরে। ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে প্রেসে পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করি। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের এই পদক্ষেপটা অনেক সাড়া ফেলে তখন।

সময় টিভির পপ্লু ভাই একটা ফিচার স্টোরিও করেন এটা নিয়ে। তৎকালীন খুলনার মেয়র মনিরুজ্জামান অনেক অমায়িক মানুষ ছিলেন।

তার সম্মতিতে তারই সমিতির অফিসে ভেট রেজাউল করিম ভাই এর টিকা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছিলো।

এরপর আমার বাবুর প্রি-স্কুল, রহিমা বেগম শিশু বিদ্যা নিকেতন এর হেডমাস্টারের উৎসাহে ওখানের বাচ্চা আর মায়েদের মাঝেও এওয়ারনেস ক্যাম্পেইন করি।

এর ফলে বেশ পজিটিভ ইফেক্ট পড়ে সবার উপর। পরবর্তীতে খুলনার মেথরপট্টিতে আবার ডগ কিলিং গাড়ি আসলে, লোকাল ছেলেদের ধাওয়া খেয়ে কোন মতে পালিয়ে যায়! হাহাহা! “

প্রাপ্তি…

ফারজানা লিও তো তাহলে বেশ সফল তার প্রাপ্তিতে- বলতেই বলে উঠলেন, “ আসলে আপু, কিছু ত্যাগ না করলে কিছু পাওয়া যায় না। তবে তার জন্য এই এনিমেল ওয়েলফেয়ারের কাজ দায়ী না। সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছু জিনিস হারাই আমি- বাবা, স্বামী, সন্তান, মা।

তবে এই অবলাদের জন্যই সেই হারানোটায় পাগল না হয়ে আবার বেঁচে থাকতে শিখি।

আসলে আজ হারানোর গল্প করতে চাইও না। কারণ এ সমাজের মানুষ যে কোন কষ্টেই দায়ী করে অত্যাচার করে ঐ অবলাদের। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে আমার পরিবারকে হারিয়ে ফেলেছি বললেও, তারা কোন না কোনভাবে ঐ অবলাদেরই হাই লাইট করবেন!

তাই সেসব কথা থাক অন্য কোন দিনের। আজ না হয় বলি আমার ওদের নিয়ে এই জীবনের প্রাপ্তির গল্প। তবে একজনের নাম মেনশন না করলেই নয়, ALB এর হৃদি না থাকলে, ওনার মেন্টাল, ফিজিক্যাল সাপোর্ট না পেলে বেশ বেগ পেতে হতো আমার নিজেকে সামলিয়ে উঠতে।

পারিবারিক ধিধ্বস্ততার মধ্যেই আমার কাজ চালিয়ে যাই। ২০১৯ সালের এপ্রিলে কক্সবাজারে একটা বড় ক্যাম্পেইন আবার আমি আর আমাদের সহযোগিরা মিলে করি।

ALB, ACC এর সুমি বিশ্বাস, RPC এর তৃষা আপু, CDB এর ইয়ানা আর আমি মিলে কক্সবাজারের প্রায় ২০০ কুকুরকে ভ্যাক্সিন দেই, গায়ে নিরাপদ রঙ দিয়ে সুচিহ্নিত করি এবং গলায় বেল্ট পরিয়ে দেই।

অবলা ওদের সাথে কাজ করে একটা মেন্টাল রিলিফ পাই। ওদের মধ্যে আমি মানুষের চাইতেও বেশি মানবিকতাকে খুঁজে পেয়েছি, যা আশেপাশের মানুষগুলোর মধ্যে অনেক খুঁজেছি।”

এবং বর্তমানের লিও…

২০১৯ এর ১লা আগস্টে মার্লিন অসুখে মারা যায় খুব অল্প সময়ের মাঝেই।

সন্তানসম মার্লিনকে হারিয়ে তার স্মৃতিকে আজীবন স্মরণীয় করে রাখতেই খুলে ফেলি “Marlin’s World”. ওখানে ট্রেড লাইসেন্স সম্বলিত ৫ টা সেক্টরে আমরা কাজ করি- ফস্টারিং, এনিমেল ফুড সেল, পেট ট্রান্সপোর্টেশন সাপোর্ট, ভ্যাক্সিনেশন আর পেট গ্রুমিং।”

পেট গ্রুমিং?- টার্মটা নতুন বলে প্রশ্ন করায় লিও হেসে বললেন, “ আমরা যারা পশুপাখি পালি, অনেকেই গ্রুমিং ব্যাপারটা জানি না। পুষ্টিকর খাবার আর নিয়মিত ভ্যাক্সিনেশন করা ছাড়াও ওদের সুস্থ এবং আরাম লাগতে গ্রুমিং করা খুব দরকার।

গ্রুমিং এর মধ্যে ওদের গায়ের লোম ছাটাই করা, নখ কেটে দেয়া, কানের ময়লা পরিষ্কার, ফিজিক্যাল চেক আপ আর ভ্যাক্সিনেশন করা হয়।

কুকুরের জন্য আমরা পার্ভো র‍্যাবিস, ক্যানাইন ডিস্টেম্পার আর বিরালের জন্য পেনিলিউকোপেনিয়া বা ফ্লু এর ভ্যক্সিন দিই। খুব জরুরি ওদের জন্য।

আর এর থেকে পাওয়া প্রফিট দিয়েই আমি ফস্টার হোমতা চাই, রাস্তার বাবুদের খাওয়াই। করোনার লক ডাউন ছাড়াও প্রতিদিন খাওয়াই। ‘আর করোনার লক ডাউনে তো আর্মির ভয়ে দিনে নামা যেত না।

রাত ১০ তার দিকে, সব লাইট অফ হলে, বিশ্বাস করবেন না- ৩৫ কেজির দুইতা বালতি ভরে খাবার রেধে ওদের জন্য প্রতিদিন নিয়ে বের হতাম রাস্তায়।

শ্যাওড়াপারা মিরপুরের এলাকায় খাবার দিতাম। লকডাউনে দোকান, হোটেল বন্ধ থাকায়- যে পরিমাণ কষ্টে থাকতো বাচ্চারা!! ঐ সামান্য খাবার পেয়ে যে চোখে আমার দিকে তাকাতো আপু, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

তাহলে বেশ ভালই আছেন আপু… হেসে আপু বললেন, “ জানেন তো, অবলা এই জীবনের নিজেদের জবান নেই।

অত্যাচারের শিকার হলে কিছুক্ষণ মরার অবধি খালি ডেকেই যায় যা। একটু ভালোবাসা পেলেই ছুটে চলে আসে।

একদিন আপনি যদি খাওয়ান, কুকুরটা আপনার জন্য জীবন দিয়েও দিবে। পৃথিবীতে এমন অনেক রেফারেন্স আছে, বাচ্চা, মালিককে বাঁচাতে গিয়ে কুকুর নিজেই সন্তান সহ জীবণ ত্যাগ করেছে।

সেই বাচ্চাগুলো জবান হয়ে যখন কাজ করি। আসলেই মনে একতা আলাদা প্রশান্তি খুঁজে পাই আপু। আর আল্লাহর ব্লেসিংও পেতে থাকি অবিরাম।

নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বার্তা

নতুন প্রজন্ম, আনাড়ি কিন্তু পশুপ্রেম আছে, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?

“অবশ্যই। ওদেরকে বলতে চাই, তোমরা ঘর থেকেই শুরু কর এই চ্যারিটি। বারান্দায় আসা পাখি , রাস্তার বিড়াল কুকুরকে খাওয়াও।

রেস্কিউ মিশনে নামতে গেলে, অবশ্যই সিনিয়ার ভাইয়া আপুদের অধীনে আগে কাজ করবে। মুখটা কিভাবে ওরা বেঁধে আতংকে থাকা পশুটাকে রেস্কিউ করে, সেটা শিখবে।

নইলে আতংকে কামড় দিলে, তুমিই যদি বিপদে থাকো, তাহলে কিভাবে ওদের বিপদ মুক্ত করবে! ধীরে ধীরে নিজের এলাকায় কাজ শুরু কর। কমিউনিটি বানাও।

আমাদের গাইড করার তো কেউ ছিলো না। নিজে নিজে শিখেছি। তোমাদের গাইড করার জন্য সিনিয়ার অনেক ভাই বোন পাবে। তাদের নক করো।

তাদের থেকে হাতে কলমে শিখে নাও।

আর আমার সহযোগিদের বলবো, প্রত্যেকটা মানুষই দোষে গুণে ভরা। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ভুলে, ঐ অবলাদের ভালোর জন্যই যে মূল মোটো, সেটা কেন্দ্র করেই আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।

আমি ১০ বছর ধরে ২ পায়ের দুই্টা লিগামেন্ট ছেড়ার ব্যাথা নিয়ে আজও যদি খুঁড়িয়ে হেঁটে হেঁটে কাজ করতে পারি, তোমরা তো আরও অনেক দূর পারবে।”

শেষ হইয়াও হইলো না শেষ…

আপু, গ্ল্যামোজেনকে এত ব্যস্ততার পরেও সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!

স্মিত হেসে ফারজানা লিও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “নারীর ইনার বিউটিকে সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার অনেক সুন্দর একটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন গ্ল্যামোজেন। আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হচ্ছি আপনাদের এই তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে।

আগে ভয় পেতাম, আমরা চলে গেলে কী হবে? এখন মনে হয়, নাহ।

মিডিয়া আর আপনাদের মতো সত্যিকার সমাজ সেবার মনোভাবের গণমাধ্যমগুলো যতদিন আছে, পথ হারাবে নাহ বাংলাদেশ।

সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা উচু করে বলতে পারব, যাওয়ার আগে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি, আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে, অবলার প্রতি যত্ন করার ব্যাপারে আপনার হুকুমটা!”

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য প্রায় ডুবো ডুবো। গ্ল্যামোজেনের রিপোর্ট লিখতে লিখতে, ল্যাপটপ থেকে চোখটা একটু জানালার বাইরে দিলাম।

মনের কল্পনাতেই যেন দেখতে পেলাম ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটা, এক মা পরম স্নেহে তার ৪ পেয়ে সন্তানগুলোকে হাত থেকে কিছু একটা খেতে দিচ্ছেন।

লেজ নাড়িয়ে বিধাতার কাছে বোধ করি সেই প্রাণগুলোও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, এমন এক মাকে তাদের জীবণে দেয়ার জন্য।

আমিও ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, সমাজ তৈরির সে মায়াবী কারিগরকে।

(ফারজানা লিও আপুর সহযোদ্ধা হতে চাইলে আমন্ত্রণ রইলো মার্লিন্স ওয়ার্ল্ড এ !)