কিশোরী ও তরুণীদের ত্বকে ব্রণের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
বাইরের ধুলাবালি, মানসিক চাপ, ভুলভাল কসমেটিকস ব্যবহার ইত্যাদি ব্রণ বাড়িয়ে তোলে৷
ব্রণ মুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়, তার চাইতেও বড় সমস্যা হল ব্রণের দাগ।
ব্রণ সারলেও মুখে ব্রণের দাগ একবার বসে গেলে সহজে দূর হওয়ার নামই করে না।
ব্রণের দাগ নিয়ে খুব অস্বস্তিতে ছিলেন না এমন নারী খুঁজে পাওয়া যাবে না।
হাজারটা উপায় ট্রাই করেছেন কিন্তু তবুও দাগ যাচ্ছেনা, কি করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না – এসব চিন্তা ত্বকের কালো দাগগুলোকে আরো উস্কে দেয়।
উঠতি বয়সের মেয়েদের মুখে ব্রণের দাগ সহজে না গেলে সেটা পরবর্তীতে আরো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
ব্রণের বিচ্ছিরি দাগ থেকে নিমেষে মুক্তি পেতে চান? আজ আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি বিভিন্ন ঘরোয়া টোটকা নিয়ে।
এই টিপসগুলো ব্যবহার করলে সহজেই ব্রণের দাগ থেকে মুক্তি মিলতে পারে। সাথে পাচ্ছেন দাগ কমানোর জন্য সহজ কিছু পরামর্শ।
১. লেবুর রস
প্রাকৃতিক ব্লিচ হিসেবে বিখ্যাত লেবু মুখে ব্রণের দাগ দূর করার জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান।
লেবুর রস দিয়ে কয়েক রকমের প্যাক বানিয়ে ব্যবহার করতে পারেন৷ শুধু লেবুর রসে তুলা ভিজিয়ে ব্রণের দাগের উপর লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে দিন।
এরপরে কুসুম গরম পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
আপনি চাইলে ১ টেবিল চামচ লেবুর রসের সাথে ১ চা চামচ পানি মিশিয়েও ব্যবহার করতে পারেন।
এই মিশ্রণে তুলার টুকরা ভিজিয়ে দাগের জায়গায় ৩-৪ মিনিট ধরে আলতো করে ঘষুন। সেনসিটিভ স্কিনের জন্য পানির বদলে গোলাপজল ব্যবহার করবেন।
আরেকটা কাজ করতে পারেন, ১ টেবিল চামচ লেবুর রসের সাথে ২ চা চামচ ভিটামিন ই ক্যাপসুল মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
১ টেবিল চামচ লেবুর রস, ১ টেবিল চামচ মধু, ১ টেবিল চামচ আমন্ড অয়েল, এবং ২ টেবিল চামচ কাঁচা দুধের প্যাক বানিয়ে প্রতিদিন একবার ব্যবহার করুন।
এক সপ্তাহ ব্যবহার করলে ব্রণের বিচ্ছিরি দাগ আস্তে আস্তে হালকা হতে থাকবে।
সামান্য চিনি আর অলিভ অয়েলের সাথে ১ টেবিল চামচ চিনি মিশিয়ে দাগের উপর মাসাজ করতে পারেন।
১০-১৫ মিনিট পরে স্বাভাবিক পানিতে মুখ ধুয়ে এরপরে ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম ব্যবহার করবেন। সপ্তাহে ২-৩ বার এই পেস্ট ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল নিশ্চিত।
২. শসার রস
শসার রস ব্রণের দাগ দূর করতে দারুণ কাজ করে। ১ টেবিল চামচ শসার রসের সাথে ১ টেবিল চামচ টমেটোর রস মিশিয়ে প্যাক বানিয়ে নিন।
এই প্যাক সারা মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিন, ১০ মিনিট পরে মুখ ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে তিনদিন এই প্যাক লাগালে ব্রণের দাগসহ রোদে পোড়া দাগও মিটে যাবে।
ব্রণের দাগ দূর করতে শসার রসের স্ক্রাব ব্যবহার করতে পারেন। পরিমাণমত শসার রস আর চালের গুঁড়া মিশিয়ে স্ক্রাব তৈরি করুন।
মধুতে অ্যালার্জি না থাকলে খানিকটা মধুও দিতে পারেন মিশ্রণের সাথে।
সপ্তাহে দুইদিন এই স্ক্রাব অবশ্যই শুধু ব্রণের দাগ তুলতেই ব্যবহার করবেন, ব্রণ থাকলে এটা ব্যবহার করবেন না।
৩. অ্যালোভেরার রস
শুধু অ্যালোভেরার জেল দিয়েও ব্রণের জেদি দাগ দূর করতে পারবেন সহজেই।
দাগ দূর করার জন্য প্রথম দুই বা তিনমাস প্রতিদিন দুইবার করে জেল মুখে লাগাবেন।
সকালে ও রাতে জেল মুখে লাগানোর পর শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন এবং শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলবেন।
আস্তে আস্তে দাগ চলে যাবে। এরপরে যদি জেল লাগাতে চান তাহলে প্রতিদিন শুধু একবার লাগালেই হবে।
৪. বেকিং সোডা
প্রাকৃতিক ব্লিচের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে বেকিং সোডা।
বেকিং সোডা ব্যবহারের সময় অবশ্যই চোখ বাঁচিয়ে ব্যবহার করবেন।
আর সোডা মুখে ব্যবহারের পর ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম বা অলিভ অয়েল লাগাতে ভুলবেন না যেন।
২ টেবিল চামচ বেকিং সোডার সাথে অল্প একটু পানি মিশিয়ে দাগের জায়গায় ২-৩ মিনিট লাগিয়ে রাখুন, এরপরে শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন।
বেকিং সোডার এই চটজলদি টোটকা সপ্তাহে দুইদিন ব্যবহার করবেন।
৫. তুলসির রস
আয়ুর্বেদিক গুণ সমৃদ্ধ তুলসি গাছ ত্বকের যত্নে অপরিসীম। আর ব্যাপারটা যদি হয় ব্রণের দাগ সারানোর, তাহলে তো কথাই নেই।
শুধু তুলসির রস দাগের জায়গায় লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন৷ রস শুকিয়ে গেলে কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
৬. মুলতানি মাটি
ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর করতে মুলতানি মাটির জুড়ি নেই। মুলতানি মাটির পেস্ট নিয়মিত লাগালে ত্বকের অতিরিক্ত তেল ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, ফলে ব্রণের উৎপাত কমবে।
আর ব্রণ যেহেতু কমবে, তাই দাগ অপসারণের ঝামেলাও কমবে।
মুলতানি-নিমের প্যাক বানিয়েও ব্যবহার করতে পারেন। ৪-৫ টি নিম পাতা পিষে এর সাথে ১ চা চামচ মুলতানি মাটি আর সামান্য গোলাপজল মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে নিন।
মিশ্রণ ঘন হয়ে গোলাপজলের পরিমাণ বানাবেন। পেস্টটা মুখে লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং স্বাভাবিক পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
৭. আলুর রস
চাইলে আলুর ছোট ছোট স্লাইস ব্রণের দাগের উপর ব্যবহার করতে পারেন বা ছেঁচে রস করেও লাগাতে পারবেন।
আলুর রস প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে একবার ব্যবহার করবেন। এভাবে ব্যবহারে ব্রণের দাগ যেতে একটু সময় লাগতে পারে।
আলুকে স্লাইস করলে সরাসরি দাগের উপর লাগিয়ে রাখবেন। আর রস করলে ত্বকে মাসাজ করবেন, ১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পরে কুসুম গরম পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলবেন।
৮. পুদিনার রস
পুদিনার রস অতিরিক্ত গরমে ব্রণ, ব্রণের দাগ, ফুসকুড়ি দূর করতে সাহায্য করে।
টাটকা পুদিনা বাটা বেটে রস বের করে ২০ মিনিট মুখে লাগিয়ে রাখুন ও ধুয়ে ফেলুন।
৯. চন্দন কাঠের গুঁড়া
চন্দন কাঠের গুঁড়া ব্রণ ও ব্রণের দাগ সারাতে একটি কার্যকরী উপাদান।
১ টেবিল চামচ হলুদ বাটার সাথে ১ টেবিল চামচ চন্দন কাঠের গুঁড়া একসাথে মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে ব্রণের জায়গায় লাগিয়ে রাখুন।
শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিক ঠান্ডা পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
১ টেবিল চামচ চন্দন কাঠের গুঁড়ার সাথে ৬-৭ ফোঁটা গোলাপজল আর ২-৩ ফোঁটা লেবুর রস মিশান।
গোলাপজলে সমস্যা থাকলে এর পরিবর্তে মধু মিশাতে পারেন। এই প্যাক সপ্তাহে তিন-চারদিন ব্যবহার করলে ভালো ফল পাবেন।
এছাড়া ১ টেবিল চামচ রক্ত চন্দন পাউডার, ১ টেবিল চামচ ডালিমের খোসার গুঁড়া, ২ চা চামচ কাঁচা দুধ বা টকদইয়ের পেস্ট দাগে ব্যবহার করতে পারেন।
নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ হালকা হবে ও ত্বক উজ্জ্বল হবে।
১০. মধু
মধু দিয়ে বিভিন্ন প্যাক বানিয়ে মুখের দাগ দূর করতে পারবেন। বা শুধু মধুও মুখে মাসাজ করতে পারেন।
মধু ত্বকের যেকোন দাগ দূর করে খুব সহজে। পরিমাণমতো মধু আর দারচিনি গুঁড়ার পেস্ট বানিয়ে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে ব্যবহার করবেন।
পরিষ্কার মুখে এই পেস্ট দাগের জায়গায় ১ ঘন্টা লাগিয়ে রেখে এরপরে ধুয়ে ফেলুন। চাইলে সারারাতও লাগিয়ে রাখতে পারেন।
আবার অ্যাসপিরিন-মধুর টনিকও ব্যবহার করতে পারেন।
অ্যাসপিরিনে থাকা স্যালিসাইলিক এসিড ব্রণের দাগ দূর করে৷
২টি অ্যাসপিরিন ট্যাবলেটের সাথে ২ চা চামচ মধু আর আধা চা চামচ মধু একসাথে মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে সাবধানে মুখে লাগাবেন।
১ চা চামচ মধু, ১ টেবিল চামচ বেসন, ২ টেবিল চামচ টকদই, এবং ১ চিমটি হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে মুখে ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন।
অথবা আপেলের পেস্টের সাথে ৫-৬ ফোঁটা মধু মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
সপ্তাহে পাঁচ বা ছয়বার ব্যবহারে ব্রণের দাগ তো হালকা হবেই, মুখের রংও উজ্জ্বল হবে।
অথবা ২ টেবিল চামচ মধুর সাথে ১ টেবিল চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার আর প্রয়োজনমতো পানি মিশিয়ে মুখে ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখতে পারেন।
১১. টক দই
সৌন্দর্য বোদ্ধাদের মতে, টকদই ব্রণের কালো দাগ দূর করার জন্য হতে পারে একটি উত্তম অপশন।
৪ চা চামচ টকদইয়ের সাথে দেড় চা চামচ হলুদ গুঁড়া মিশিয়ে মিশ্রণ বানিয়ে মুখে মাসাজ করুন।
১০ মিনিট পরে স্বাভাবিক পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন। ব্রণের দাগ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত নিয়মিত এই মিশ্রণ ব্যবহার করুন।
মুখে ব্রণের দাগ কমাতে কিছু টিপস
- অপরিষ্কার ত্বকই ত্বকের সকল সমস্যার আধার। কাজেই ব্রণ ঠেকাতে ত্বক পরিষ্কার রাখার কোন বিকল্প নেই।
- পর্যাপ্ত পানি পানে রক্ত পরিষ্কার থাকে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি খেলে ব্রণের সমস্যা অনেকটা কমাতে পারবেন।
- মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন সবসময়। স্ট্রেস ব্রণের অন্যতম প্রধান একটি কারণ।
ব্রণের দাগ নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করলে দাগ আরো স্থায়ীভাবে গেঁথে বসবে মুখে।
পর্যাপ্ত ঘুম আর যোগব্যায়াম করে স্ট্রেস কমাতে পারেন। - নখ দিয়ে ব্রণ খুঁটলে বিচ্ছিরি দাগ খুব তাড়াতাড়ি বসে যায় মুখে।
কারণ নখের আঁচড়ে ব্রণের উপরিভাগ লাল হয়ে যায়, আবার ব্রণ ফেটে ভিতরের রস ছড়িয়ে দাগ পড়ে যায়।
কাজেই ব্রণে কখনোই নখ লাগাবেন না। - সূর্যের আলোতে ব্রণের কালো দাগ আরো পাকাপাকিভাবে ত্বকে বসে যায়।
তাই বাইরে বের হওয়ার আগে সানস্ক্রিন মেখে নিবেন। ছাতা, হ্যাট, বা স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে চেষ্টা করবেন।
সবচেয়ে ভালো হয় যদি রোদে বাইরে বের না হন। - বাইরে থেকে এসে ভালো মানের ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধোয়ার চেষ্টা করুন।
প্রতিদিন ফেসওয়াশ ব্যবহারে ত্বকে লেগে থাকা ময়লা বের হয়ে যাবে।
ফেসওয়াশ না থাকলে গরম পানির ভাপও নিতে পারেন। এতে করে ত্বকের গভীর থেকে সহজেই ময়লা পরিষ্কার হবে। - পুষ্টিকর খাবার বেশি করে খাবেন এবং তেল-মশলা থেকে শত হাত দূরে থাকবেন।
প্রতিদিন একটি করে ভিটামিনসমৃদ্ধ ফল খেলে ত্বক থাকবে সতেজ, ব্রণের উৎপাতও কমবে। - মুখে ব্রণ থাকলে মেকআপ না করাই ভালো।
এছাড়াও প্রতিদিন দুইবার ওয়াটার-বেইজড ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধোয়ার চেষ্টা করবেন।
ক্লিনজারটা যেন তেলমুক্ত হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। - ব্রণের দাগ সহজে না গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
আবার দাগ কমানোর জন্য কোন ওষুধ বা ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করা শুরু করলে হালকাভাবে ত্বকে ব্যবহার করবেন।