Search
Close this search box.

স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারের নিরাপদ কৌশল

পিরিয়ড বা মাসিক, নারীজীবনের ক্ষেত্রে  খাওয়া, ঘুম, মল-মূত্র ত্যাগের মতোই বেসিক ফান্ডামেন্টাল জৈবিক চাহিদা।

ভৌগোলিক অবস্থান এবং পুষ্টিগত দেহবৃতির জন্য, আমাদের দেশের মেয়েদের গড়ে ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে সাধারণত প্রতিমাসে এই মাসিক এর সময়টা আসে।

গড়ে ২৮ দিন পর পর এর স্থায়ীত্বকাল শরীর এবং পারিবারিক কেইস হিস্ট্রিভেদে ৩ থেকে ৯ দিন পর্যন্ত থাকে।

এসব কথা ২০২১ সালের এই বৈজ্ঞানিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এসে বেশ সাধারণ।

কম বেশি সবাই জানেন, নারী-পুরুষ ভেদে এসব ইনফরমেশন।

কিন্তু যে বিষয়টা এখনও কেউ ভালো করে জানেন না- তা হল মাসিকের সময়ে সঠিকভাবে কি রূপে হাইজিন মেইনটেইন করলে স্বাস্থ্যগত সমস্যা থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।

এবং এই মেইন্টেনেন্সের মধ্যে যে জিনিসটা আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়, তা হলো স্যানিটারি ন্যাপকিন।

এই ন্যাপকিন গঠন-গত দিক থেকে প্রধানত ৩ ধরণের হয়ে থাকে।

স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য, এই ৩ প্রকার ন্যাপকিন বা প্যাডের ব্যবহারেরও রকম ভেদ আছে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, খোদ নারীদের মধ্যেই অনেকে এ সকল প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সঠিক ব্যবহার জানেন না।

এর ফলস্বরূপ বর্তমানে নারী স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, ইউরিন ইনফেকশন, ওভারি ইনফেকশন, জরায়ু ক্যান্সার, বন্ধ্যান্ত্ব সহ নানা রোগ প্রকটভাবে বেড়েছে।

এসকল রোগ থেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে, নারীদের এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষী পুরুষদেরকে সচেতনকরণ এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করতেই গ্ল্যামোজেনের আজকের আয়োজন।

প্যাডের প্রকারভেদ

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের দেশে যে প্যাডগুলো বাজারে পাওয়া যায়, গঠন প্রণালীর দিক থেকে সেগুলোকে প্রধানত ৩ ভাগে ভাগ করা যায়।

স্যানিটারি জেল-ফাইবার প্যাড, তুলা-গজ কাপড়ের প্যাড এবং কাপড়ের প্যাড।

আরও একধরণের প্যাড গ্রামে ব্যবহার করা হয় এখনও- পুরাতন কাপড় দিয়ে পেচিয়ে বানানো ঘরে তৈরি।

স্বাস্থ্যগতদিক থেকে এসব প্যাড মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বলে, অভিজ্ঞ গাইনোকলজিস্টদের সাথে সাথে গ্ল্যামোজেনও সম্পূর্ণরূপে এসব প্যাডের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করছে।

স্যানিটারি জেল-ফাইবার প্যাড

বাজারে আল্ট্রা শোষণ ক্ষমতা এবং নরম টেক্সচারের জন্য বেশ জনপ্রিয় এসকল প্যাড।

দামে বেশ খরচবহুল হলেও ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরামদায়ক বলে অনেকেই এই প্যাডের দিকে ঝুঁকে থাকেন।

তবে এদিক থেকে জেনে রাখা দরকার, কেমিক্যাল জাতীয় ব্যবহার সবচেয়ে বেশি এই প্যাড তৈরীতে করা হয়ে থাকে।

এই প্যাডগুলো কখনও কেটে খুললে, বা পানিতে সামান্য ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর ডললে দেখা যাবে, ছোট ছোট স্বাচ্ছ সাদা বলের মতো দানা বের হয়ে আসছে।

এগুলৈ সেই বিশেষ জেল বল, যা প্যাডগুলোয় ব্যবহার করা হয় শোষণ ক্ষমতাকে দ্রুত এবং সর্বোচ্চ করার জন্য।

এবং এই জেলগুলোয় উপস্থিতিই এই প্যাডগুলোকে সবচেয়ে ক্ষতিকারক করে তোলে।

এই প্যাডগুলো ৩-৪ ঘন্টার অধিক ব্যবহার করলে, এই জেল বলগুলো আপনাআপনি রিলিজ হয়ে যায় প্যাড থেকে।

যতই এগুলোকে আটকে রাখার জন্য ফাইবার ব্যবহার করা হোক না কেন, শরীরের সাথে ঘষা খেয়ে, সামান্য জলীয় স্পর্শ- রক্ত/ঘামের সাথে ছোঁইয়া লাগলেও জেল বলগুলো নানাভাবে বের হয়ে আসে।

আজ পর্যন্ত এমন কোন প্যাড আবিষ্কার করা যায় নি, যা রক্ত শোষণ ক্ষমতার ফেব্রিক ব্যবহার করেছে, এবং জেল বলগুলোকে আটকে রাখতে পেরেছে।

শরীরের উপর কেমন প্রভাব ফেলে এই জেল বল

এই জেল বলগুলো রিলিজ হলে, এতে থাকা কেমিক্যালের প্রভাবে অনেক সময় স্কিনে র‍্যাশ ওঠে বা দীর্ঘকালীন ইনফেকশন হয়।

এই জেল বলগুলো কোনভাবে জরায়ুতে প্রবেশ করলে, কিংবা জরায়ুর মুখে আসলে, ভয়ংকর ধরণের ইনিফেকশন হতে পারে।

ব্যাকটেরিয়ার সাথে সংক্রমণ করে যেসব ইনফেকশন সৃষ্টি হয়, তার কারণে বন্ধ্যাত্বকরণ ; এমন কি কখনও কখনও জরায়ু কেটেও ফেলা লাগে।

এছাড়া ওভারিয়ান ক্যান্সার হওয়ার অন্যতম মূল কারণ দীর্ঘদিন এসকল জেল বলের সংস্পর্শে থাকা।

এছাড়াও এসকল প্যাডকে সাদা রাখার জন্য এবং দূর্গন্ধমুক্ত করার জন্য যে সকল কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, তাও স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক-ক্যান্সারজিন।

বিপদসীমার দিক থেকে এসকল প্যাড যদি ভুল নিয়মে ব্যবহার করা হয় নিয়মিত, তবে এর চাইতে বিপদজনক কোন প্যাড হতে পারে না।

তাই এই প্যাডগুলো ব্যবহারের সময় যে ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখতে হবে-

১. অবশ্যই ৩ থেকে ৪ ঘন্টা পরপর প্যাড বদলাতে হবে।

২. প্রতিবার প্যাড বদলানোর সাথে সাথে, প্যাডের সাথে ব্যবহৃত প্যান্টিও বদলাতে হবে।

কেননা,প্যাডে তৈরী ব্যাকটেরিয়া এবং জেলবলগুলো প্যান্টিতেও সংক্রমণিত হয়/ লেগে থাকে।

তাই এই প্যান্টীগুলো প্রতিবার চেঞ্জ না করলে, আসলে ৪ ঘন্টা পর পর শুধুমাত্র প্যাড চেঞ্জ করা আর না করা- একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

কেননা, সেই ব্যাকটেরিয়া এবং জেল বলের সংক্রমণের রিস্ক একই থাকে।

৩. প্রতিবার প্যাড-প্যান্টি বদলানোর আগে ভালো করে দুই পা, উরু এবং মধ্যবর্তী স্থান ভালো করে পানি দিয়ে ধুয়ে, পরিষ্কার কাপড়ে মুছে নিতে হবে।

এভাবে নিয়ম মেনে ব্যবহারে, দৈনিক ৬-৭ টা ওয়াড লাগতে পারে।

এটা কিছুটা ব্যয় বহুল হলেও, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তার তুলনায় কিছুই না।

এসব না মেনে পরবর্তীতে বন্ধ্যাত্ব কিংবা ক্যান্সার হলে যে পরিমাণ খরচ এবং মরণের আশংকা তৈরী হবে, তার তুলনায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে এই প্যাড ব্যবহারের খরচটা নিতান্তই তুচ্ছ্য!

তুলা-গজ কাপড়ের প্যাড

বাজারে পাওয়া যায় যে সকল প্যাড, তার মধ্যে এ সকল প্যাড সবচেয়ে কমদামের।

সাধারণ তুলা এবং গজ কাপড়ের তৈরি হয়।

সাধারণত জেল বল থাকে না।

তাই লিকেজের পরিমাণ/ আশংকা বেশি থাকে।

তার চাইতেও মারাত্মক থাকে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা।

কেননা, রক্তের ফোঁটা পরার ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে, তুলা আর কাপড়ের সাথে ঐ আর্দ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়ার কালচার বা সংক্রমণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।

এসকল ব্যাক্টেরিয়া পেশাবের জ্বালাপোড়া, ইউরিন ইনফেকশন, কিডনি ড্যামেজ থেকে শুরু করে, জরায়ুর নানা জটিল রোগ এমন কি বন্ধ্যাত্বের জন্যও দায়ী।

এছাড়া গজ কাপড় দীর্ঘসময় আর্দ্র পরিবেশে থাকলে চামড়ার সাথে নানা ফাংগাল ইনফেকশনও তৈরি করে থাকে।

তাই পূর্বে বলা পদ্ধতিতে এসকল প্যাডও ৩-৪ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই চেঞ্জ করা লাগবে নিরাপদ থাকতে।

কাপড়ের প্যাড

বাজারে পাওয়া প্যাডগুলোর মধ্যে এসকল প্যাদ মোটামুটি দামী হলেও,  অপেক্ষেকৃত নিরাপদ।

বেশ কিছু কাপড়ের সমন্বয়ে এ প্যাডগুলো সেলাই করে বানানো হয়।

অনেক সময় বাসাতেও সুতি কাপড় সেলাই করে বানানো হয়।

এই প্যাডগুলো ধুয়ে, শুকিয়ে বারবার করে ব্যবহার করা যায়।

তবে এই প্যাডগুলোর অসুবিধা হল, লিকেজের সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে; তাই বেশিক্ষণ ব্যবহার করা যায় না।

তাও এটা কিছু ক্ষেত্রে বিপদজনক।

কারণ, পিরিয়ডের শেষের দিকে, যখন ব্লিডিং অল্প হয়, তখন এই প্যাডগুলোয় বেশি রক্ত না লাগায়।

অনেকেই সে সময়ে দীর্ঘকাল ব্যবহার করে।

যা মারাত্মক বিপদজনক।

নিচে এই প্যাডগুলো ব্যবহারের নিরাপদ উপায়গুলো আলোচনা করা হল-

১. তুলা সরাসরি না থাকলেও, এই প্যাডগুলো যেহেতু কাপড়ের তৈরি; তাই আর্দ্র সংস্পর্শে আসলেই এই প্যাডগুলোয় ব্যাকটেরিয়া কালচার শুরু হয়ে যায় ৩-৪ ঘন্টার মধ্যেই।

তাই এগুলোও  সর্বোচ্চ ৪ ঘন্টা পর পর প্যান্টিসহ বদলে ফেলতে হবে।

২. এগুলো ধোয়ার ক্ষেত্রে, সোডা সহ গরমপানিতে সাবান দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে, কড়া রোদে ভালো করে শুকাতে হবে।

কোন কিছুর আড়ালে/ কোণায় ছায়ায় শুকাতে দিলে, সেখানে আরও মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবে।

৩. এই কাপড়ের প্যাডগুলোও ৩ মাস পর পর ফেলে দিতে হবে।

এবং নতুন কাপড়ের প্যাড কিনে/ বানায়ে ইউজ করতে হবে।

৩ মাসের বেশি একই কাপড়ের প্যাডের ব্যবহার স্বাস্থ্যঝুঁকি ৮০% বাড়িয়ে দেয়।

বিবিধ

এছাড়া অনেকেই প্যাডের খরচ বাঁচাতে প্যাডের উপর টিস্যু পেঁচিয়ে ব্যবহার করে, তা সে যে কোন ধরণের প্যাডই হোক না কেন।

 এটা যে কতটা  ভয়ংকর,তা বলে বোঝানো সম্ভব না।

 প্রথমত, এই টিস্যু প্যাডের ব্যাকটেরিয়া কালচারের পরিমাণকে তুরাণ্বিত করে।

দ্বিতীয়ত, ভেজা থাকাকালে, কোনভাবে এই টিস্যুর কণাগুলো যদি জরায়ুর রাস্তা বরাবর চলে যায়; এর থেকে কি মারাত্মক রোগের যে সৃষ্টি হতে পারে, সেটা কল্পনাও করা যাবে না।

শুধু এটুকু বলতে চাই, অনেক সময় এই টিস্যুর কণার থেকে হওয়া ইনফেকশনের দরুণ, রোগীর জান বাঁচাতে জরায়ু কেটে ফেলেও দেয়া লেগেছে।

আশা করি বোঝা যাচ্ছে কতটা ক্ষতিকারণ এই টিস্যুর ব্যবহার।

নারীর মূল সৌন্দর্য্য তখনই পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, যখন সে থাকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ।

আর এই সুস্থ থাকার একটা ভাইটাল ফ্যাক্টর হল, এই পিরিয়ড কালীন নিরাপত্তা অবলম্বন।

গ্ল্যামোজেনের বিশ্বাস, আমাদের পাঠকেরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই সঠিক তথ্যগুলোকে উপলব্ধি করে নিজেরা সচেতন থাকবে।

আপনজনদের সচেতন করবে তাদের নিরাপত্তার খাতিরে।

কেননা, বর্তমানে ক্যান্সার-প্রবণ পরিবেশে এই সতর্কতার কোন বিকল্প নেই।

এই প্রত্যাশাতেই শেষ করছি, গ্যামোজেনের আজকের আয়োজন।