সৌন্দর্যসচেতন মানুষদের কাছে টি ট্রি অয়েল বেশ জনপ্রিয়। এটি আমাদের ত্বকের যত্নে, চুলের যত্নে ও নোখের যত্নেও বিশেষ উপকারী। তাছাড়াও এটি নানা কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি খুব বেশি ব্যয়বহুল না হওয়ায় সবাই খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে।
টি ট্রি অয়েল কী?
টি ট্রি অয়েল আসলে কি চা গাছের পাতা থেকে উৎপন্ন এক ধরণের তেল?
মজার ব্যপারতো এখানেই। এটা মোটেই আমরা যে চা পান করি সে চা পাতা বোঝায় না। এটার মানে চা পাতার তেল হলেও এটা তা নয়।
একটি গুল্ম জাতীয় গাছ “মেলালিউকা আল্টারমিফোলিয়া” (Melaleuca alternifolia) থেকে উৎপন্ন তেল টি ট্রি অয়েল হিসেবে পরিচিত।
এটি মূলত অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের উত্তর পূর্ব উপকূলীয় এলাকার উদ্ভিদ।
টি ট্রি অয়েল কীভাবে কাজ করে?
এই টি ট্রি বা মেলালিউকা আল্টারমিফোলিয়া গাছের পাতা যুগ যুগ ধরে নানা কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেখানকার লোকেরা এটিকে চায়ের মত পান করে জ্বর, ঠান্ডা, কাঁশির উপশম ঘটাতো।
এর থেকে নির্যাস বানিয়ে বা ডিরেক্টলি ব্যবহার করেও চুলের ও ত্বকের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করতো।
টি ট্রি অয়েলে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি উপাদান।
এই উপাদান গুলো বিভিন্ন ধরণের ব্যাক্টেরিয়া, ফাঞ্জাই ও ভাইরাস ধ্বংস করতে খুব কার্যকরী।
যার কারণে বিভিন্ন ঔষধ ও রুপচর্চা বিষয়ক কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
ত্বকের যত্নে যেভাবে ব্যবহার করবেন
মেলালিউকা আল্টারমিফোলিয়া গাছের পাতা থেতলে তেলের নির্যাস নেয়া হয়।তা থেকে এসেন্সিয়াল অয়েল তৈরী হয়। এই অয়েল আমাদের ত্বকের নানা ধরণের কাজে ব্যবহৃত হয়।
সেই গুলো উল্লেখ করা হলো।
পিম্পল বা একনে প্রতিরোধে টি ট্রি অয়েল:
টি ট্রি অয়েল পিম্পল ও একনে প্রতিরোধে খুবই জনপ্রিয়। টি ট্রি অয়েলে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিইনফ্লেমাটরি ও অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল উপাদান।
এটি ত্বকের গভীরে গিয়ে ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। এইভাবে পিম্পলের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোধ করে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- পছন্দের কেরিয়ার অয়েল: আমান্ড তেল, আর্গান অয়েল, সূর্যমুখীর তেল
- ২/৩ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- পছন্দের যেকোনো একটি কেরিয়ার অয়েল বাছাই করুন।
- একটি শুকনো খালি বাটিতে এক টেবিল চামচ পছন্দের কেরিয়ার অয়েল নিন।
- তার মধ্যে ২/৩ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল এড করুন।
- ভালোভাবে মিএক্স করুন। একটু তুলোর প্যাডের মাধ্যমে সার্কুলার মোশনে ম্যাসাজ করুন।
- যে জায়গায় পিম্পল হয়েছে সেইখানে এপ্লাই করুন।
- ৫/৬ মিনিট রেখে দিন। কিচ্ছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলবেন
এইভাবে রেগুলার ব্যবহার করলে খুব শীঘ্রই পিম্পল দূর হবে।
ড্রাই স্কিন প্রতিরোধে টি ট্রি অয়েল
চুলকানো ও রেডনেস দূর করে ত্বক প্রশমিত করতে টি ট্রি অয়েল খুব ভালো কাজ করে।
শুষ্ক ত্বক ময়েশ্চারাইজ করতে এসেন্সিয়াল অয়েলের জুরি নেই। এটি ত্বকের প্রদাহ কমিয়ে ত্বক ময়েশ্চারাইজ করে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- যেকোনো অয়েল বেইজড ময়েশ্চারাইজার
- টি ট্রি অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- একটি বাটিতে অল্প পরিমাণে আপনার ময়েশ্চারাইজার টি নিন।
- এর মধ্যে ৪/৫ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল এড করুন।
- খুব ভালোভাবে এই উপাদান ২ টি মিক্স করুন।
এই টি ট্রি অয়েল যুক্ত ময়েশ্চারাইজারটি মুখ ধোয়ার পর পর ই এপ্লাই করে ফেলবেন। প্রতিদিন ২ বার করে ব্যবহার করতে হবে।
তাহলে আপনার ড্রাই স্কিনের জন্য এটি খুব ভালো রেজাল্ট দিবে।
তৈলাক্ত ত্বকের জন্য টি ট্রি অয়েল
ট্রি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েলে রয়েছে এন্টিসেপ্টিক উপাদান। এই উপাদান ত্বকের অতিরিক্ত তেল উৎপন্ন হয়ে বাধা দেয়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- ৩০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন
- টি ট্রি অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- সানস্ক্রিন এর সাথে কয়েকফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল এড করুন।
- ভালোভাবে মিক্স করে সেটা এপ্লাই করুন।
শুধু বাইরে যাওয়ার সময় না। বরং ঘরে থাকা অবস্থায়ও এই প্যাকটি আপনার ত্বকে এপ্লাই করুন।
এই প্যাক ব্যবহারের ফলে অনেক উপকারিতা ও উন্নতি হবে।
সানবার্ন দূর করতে টি ট্রি অয়েল
ট্রি ট্রি অয়েলে রয়েছে ত্বক উপশম করার গুণাবলি। টি ট্রি অয়েলের অন্যান্য গুণাবলি সূর্যের পোড়া দাগ কমাতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- অ্যালোভেরা জেল
- টি ট্রি অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- বাজার থেকে কিনে আনতে পারেন বিভিন্ন ব্র্যান্ড এর অ্যালোভেরা জেল।
- কিন্তু আপনি যদি আপনার নিজের গাছ থেকে তাজা অ্যালোভেরা পাতা সংগ্রহ করতে পারেন সেটা বেশি উপযোগী।
- পাতা ফলা করে কেটে মাঝ থেকে জেল বের করে ব্লেন্ড করে নিন। আর বাজার থেকে কেনা জেল আর কিছু করতে হবে না। সেটা এক চামচ নিন।
- বাটিতে নিয়ে তারমধ্যে ৩/৪ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল এড করুন।
- ভালোভাবে মিক্স করে নিন।
এই প্যাকটি আপনার সানবার্ন এরিয়াগুলোতে এপ্লাই করুন ভালোভাবে। সপ্তাহে একদিন পর পর করার ফলে ভালো রেজাল্ট পাওয়া যাবে।
দাগ-ছোপ কমাতে টি ট্রি অয়েল
এত এত গুণে ভরপুর টি ট্রি অয়েল ত্বকের দাগছোপ কমাতেও দারুণ। এটি আমাদের ত্বকে হওয়া কালো কালো দাগছোপ কমাতে খুব কার্যকরী।
পিম্পলের খুব জেদি দাগ দূর করতেও সাহায্য করে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- টমেটোর রস
- টি ট্রি অয়েল
- আলুর রস/শশার রস
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- একটি বাটিতে পাকা টমেটো ম্যাশ করে নিন।
- তার মধ্যে এড করুন এক টেবিল চামচ আলু বা শশার রস।
- এর মধ্যে দিন ৩/৪ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল।
- খুব ভালোভাবে মিক্স করুন।
- আপনার ত্বকের দাগ খুব পুরোনো হপে মধু এড করে নিতে পারেন।
সব গুলো উপকরণ একসাথে মিক্স করে সম্পূর্ণ ত্বকে এপ্লাই করবেন। ১৫/২০ মিনিট রেখে দিতে হবে। তারপর ধুয়ে ময়েশ্চারাইজার এপ্লাই করত্র হবে।
চুলের যত্নে টি ট্রি অয়েল
টি ট্রি অয়েল ত্বকের যত্নে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি চুলের জন্য বেশ উপকারী। টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের মাথার ত্বক ভালো থাকে।
এটি ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে।
টি ট্রি অয়েলের কার্যকারিতা তুলে ধরা হলো
হেলদি স্ক্যাল্প
মাথার ত্বক স্বাস্থ্যকর থাকলে চুল পড়া, চুল লম্বা না হওয়া ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। স্ক্যাল্প ভালো থাকলে চুল পড়া কমে চুল লম্বা ও ঘন হয়
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- নারকেল তেল/ আমান্ড তেল/ক্যাস্টর অয়েল
- টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- প্রথমে প্যানে আপনার পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো তেল নিয়ে হালকা তাপমাত্রায় গরম করে নিন।
- কিছুক্ষণ পরে সেটা নামিয়ে নিন। বাটিতে ঢেলে ঠান্ডা হতে দিন।
- এই তেলে ৪/৫ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল এড করুন।
- ভালোভাবে মিক্স করুন।
- আপনার তালুতে অল্প অল্প করে নিয়ে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করুন।
এইভাবে রাতে ঘুমানোর আগে ম্যাসাজ করলে মাথার ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। ফলে চুল পড়া বন্ধ ও নতুন চুল ও গজাবে।
খুশকি দূর করতে টি ট্রি অয়েল
আমরা সবাই জানি খুশকি খুব নাছোড়বান্দা ধরনের। এর থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কষ্টকর। কিন্তু টি ট্রিতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাংগাল গুণাগুণ।
এই উপাদানগুলো খুশকি দূর করতে খুব কার্যকরী।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- পানি
- লেবু
- টি ট্রি অয়েল
- স্প্রে বোতল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- একটি স্প্রে বোতলে ৫০০ মিলি পানি নিন।
- এর মধ্যে এক চামচ লেবু এড করুন
- তার মধ্যে কয়েকফোটা টি ট্রি অয়েল এড করুন।
- স্প্রে বোতলের মাধ্যমে চুলের গোড়ায় ও চুলে ভালোভাবে স্প্রে করুন।
- সম্পূর্ণ স্প্রে করার পর চুল শুকাতে দিন।
- ৪০/৪৫ মিনিয় পর চুল ধুয়ে ফেলুন
এইভাবে রেগুলার ওয়াশের আগে হেয়ার স্প্রের মাধ্যমে স্প্রে করলে খুশকির হাত খুব শীঘ্রই রক্ষা পাওয়া যাবে।
উকুন দূর করতে টি ট্রি অয়েল
উকুনের মতো বাজে ধরণের সমস্যার হাত থেকে টি ট্রি অয়েল আপনাকে রক্ষা করবে। টি ট্রি এর ঝাঝালো ফ্লেভার উকুন নিতে পারে না।
ফলে এটি ব্যবহারের ফলে উকুন দূর হবে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- নিম
- নারকেল তেল
- টি ট্রি অয়েল
যেভাবে ব্যবহার করবেন:
- নিম পাতা রোদে শুকিয়ে নিন। একদম শুকনো হয়ে গেলে ব্লেন্ডারের মাধ্যমে গুড়ো করে নিন।
- গুড়ো করা নিম পাতার সাথে ৩/৪ টেবিল চামচ নারকেল তেল এড করুন।
- মিক্সারের সাথে এড করুন ৪/৫ ফোটা টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল।
- খুব ভালোভাবে মিক্স করে নিন।
- হাতের তালুতে নিয়ে ও আঙ্গুলে নিয়ে মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করতে থাকুন।
- এইভাবে ৫/৬ মিনিট পর্যন্ত ম্যাসাজ করুন।
- ৫/৬ মিনিট পর মাইল্ড শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এইভাবে সপ্তাহে ৩/৪ বার ব্যবহার করতে হবে। তাহলে উকুন খুব দ্রুত বিদায় নিবে। সম্ভব হলে রেগুলার ম্যাসাজ করতে পারেন।
ত্বক ও চুলের পরিচর্যার পাশাপাশি এটি অন্যান্য গুণাবলি দ্বারাও ভরপুর।
- টি ট্রি এসেন্সিয়াল অয়েল হোম ডিফিউসার এ এক থেকে দুই ফোটা দেয়ার ফলে ঘরে সুঘ্রাণ বজায় থাকবে।
- টি ট্রি অয়েল এর ঘ্রাণ মাথা ব্যথা দূর করে ও ঘুমাতে সাহায্য করে।
- এটি মস্কিউটো রেপিল্যান্ট হিসেবে দেখা করে।
- ব্যথা নিরাময়ে খুব ভালো ফলদায়ক।