Search
Close this search box.

ইচ্ছাশক্তি বাড়াবেন যেভাবে

‘ক্যারলী টেক্যাকস্’। কিংবদন্তী এক শুটার। ১৯১০ সলে হাঙ্গেরীতে যার জন্ম। ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা সেরা কিছু হওয়ার।

বড় হয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি বিশ্বসেরা শুটারদের একজন হয়ে উঠেন।

শুটিংয়ে যতগুলো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ ছিল তার সবকটি তিনি ঐ বয়সে জিতেছিলেন।

সে থেকে তার জীবনের শুধু একটিই লক্ষ্য ছিল ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জেতা।

কিন্তু সে সময় হাঙ্গেরীতে রুল ছিলো কেবল কমিশন্ড অফিসাররা-ই অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার যোগ্য হবে।

তাই একজন সার্জেন্ট হওয়ায় ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে অংশ নেয়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হন।

স্বপ্নপূরণে বাধা

স্বপ্নপুরণে প্রথম বাধা আসে ‘ক্যারলীর’ জীবনে। কিন্তু বার্লিন অলিম্পিকের পর হাঙ্গেরীর সরকার এ নিয়মটি তুলে নেন।

যেটি ১৯৪০ সালে হতে যাওয়া অলিম্পিকে তার অংশগ্রহণের দরজা খুলে যায়।

সমগ্র বিশ্বের চোখ তখন ‘ক্যারলী’র উপর। কারণ ক্রীড়া বিশ্বের সবাই জানতেন ‘ক্যারলী’ সেরা।

কিন্তু স্বপ্ন পুরণের ঠিক দু’বছর আগে আর্মিক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলাকালীন একটি গ্রেনেড তার হাতে বিস্ফোরিত হয়!

যার ফলে তার সবচেয়ে দক্ষ ডান হাতটি শরীর থেকে কেটে ফেলতে হয়! মুহুর্তে তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ধূলোয় মিশে যায়।

চারদিক থেকে পরিচিতজনরা তাঁকে সমবেদনা জানাতে আসে।

এরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ হয়তো ভাগ্যের পরিহাস ভেবে বাকী জীবন কাটিয়ে দিত।

কিন্তু ‘ক্যারলী’ তাতে দমে যাননি।

তিনি জীবনে যা হারিয়েছেন তার ডান হাত সেটির উপর ফোকাস না করে এখনো যা অবশিষ্ট রয়েছে অর্থাৎ বাম হাতের উপর ফোকাস করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

যা ঘটে গেছে তা নিয়ে দুঃখ করে বাকী জীবন কাটিয়ে দেয়ার বদলে তার বাম হাতটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা পিস্তল শুটিং হাত বানানোর উদ্দ্যেশে নবদ্যোমে যাঁপিয়ে পড়েন।

যে বাম হাত দিয়ে ‘ক্যারলী’ একটি অক্ষর পর্যন্ত লিখতে পারতেন না সেই বাম হাত দিয়ে তিনি ইতিহাস রচনার সিদ্ধান্ত নিলেন।

দুর্ঘটনার পর তাকে এক মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।

কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরুনো মাত্রই তিনি বাম হাতের ট্রেনিং শুরু করেন।

অতঃপর স্বপ্নজয়

এর ঠিক এক বছর পর ১৯৩৯ সালে হাঙ্গেরীর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ চলাকালে ‘ক্যারলী’ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন।

‘ক্যারলী’কে দেখে সবাই খুব খুশি।

এত বড় দুর্ঘটনার পরও ‘ক্যারলী’ যে তাদের উদ্দীপনা যোগাতে এসেছেন তাঁর এ খেলোয়াড়ী স্পিরিট দেখে সকল প্রতিযোগিরা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে আসেন। 

তারপর ‘ক্যারলী’ যখন বললেন, আমি তোমাদের উদ্দীপনা যোগাতে আসিনি, এসেছি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে।

তাঁর একথা শুনে সবাই অবাক হওয়ার পাশাপাশি হাসাহাসিও শুরু করে।

কিন্ত কেউ জানতো না ‘ক্যারলী’ গোপনে এই এক বছর তার বাম হাতটিকে শুটিংয়ের জন্য প্রস্তুত করছিলেন।

সে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে ‘ক্যারলী’  সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে বাম হাতে চ্যাম্পিয়ন হয়।

এ অকল্পনীয় ঘটনা সবাইকে মোহমুগ্ধ করে তোলে। 

চারিদিকে ‘ক্যারলী’র নাম ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু এসব নাম যশ কিছুই ‘ক্যারলী’র জীবনের লক্ষ্য ছিল না।

তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল অলিম্পিকে বিশ্বসেরা শুটার হয়ে স্বর্ণপদক জেতা।

তাই যতই তিনি প্রশংসা ও সমবেদনা পান না কেন তিনি তার লক্ষ্যের উপর থেকে চোখ সরাননি।

তিনি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন ১৯৪০ সালে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের উপর।

ইতিহাস রচনা

কিন্তু সে সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার কারণে ১৯৪০ সালের অলিম্পিক বাতিল হয়ে যায়।

‘ক্যারলী’ হাল না ছেড়ে আবারও ১৯৪৪ এ অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিকের জন্য ট্রেনিং চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪৪ এর অলিম্পিকও বাতিল ঘোষিত হয়। সময় অন্তহীনভাবে ‘ক্যারলী’র ধৈর্য্য পরীক্ষা নিতে থাকে।

কিন্তু ‘ক্যারলী’ লক্ষ্যে ছিলেন অটল। এবার তিনি ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকের জন্য প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯৪৮ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ‘ক্যারলী’ যখন অংশগ্রহণ করতে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিলো ৩৮ বছর।

সে সময়ে সারা বিশ্ব থেকে উঠে আসা সবচেয়ে তরুণ ও প্রতিভাবান প্রতিযোগিদের সাথে তাঁকে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে হবে।

যেখানে দক্ষ সব খেলোয়ারা তাদের দক্ষ হাত দিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে এসেছিল সেখানে ‘ক্যারলী’ তাঁর একমাত্র হাত বাম হাত দিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে এসেছে। 

‘ক্যারলী’র পক্ষে ৩৮ বছর বয়সে তরুণ প্রতিভাবানদের হারানো, যা এক কথায় ছিল অসম্ভব।

কিন্তু ‘ক্যারলী’র অভিধানে অসম্ভব বলে কোন শব্দ ছিল না। ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক গেমসে সবচেয়ে জনপ্রিয় শুটার ছিল ‘কার্লোস ভ্যালিয়ান্তে’।

সেবার সে স্বর্ণপদক জিতবে বলে সবাই ধরে নিয়েছিলো।

শিক্ষনীয় যে বিষয়

সেই ‘কার্লোস ভ্যালিয়ান্তে’ ‘ক্যারলী’কে দেখে তাঁর দুর্ঘটনার জন্য সমবেদনা জানাতে এসে জিজ্ঞেস করেন, আপনি এখানে কেন এসেছেন?

‘ক্যারলী’র উত্তর, কীভাবে একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে হয় সেটাই শিখতে এসেছি।

যথারীতি ১৯৪৮ এর অলিম্পিক শুরু হয় এবং তাঁর অভাবনীয় মনের জোর, প্রবল ধৈর্য্য এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়ে ‘ক্যারলী’ তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নপূরণ করতে সক্ষম হন।

সেবার ‘ক্যারলী’ তাঁর একমাত্র হাত, বাম হাত দিয়ে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে বিশ্বসেরা শুটারের খেতাবে ভূষিত হন।

এতদূর পৌঁছেও ‘ক্যারলী’ থেমে যাননি। ১৯৫২ সালে হওয়া অলিম্পিকে তিনি আবার অংশগ্রহণ করেন।

৪২ বছর বয়সে টানা দু’বার শুটিংয়ে তাঁর সেই বাম হাতে স্বর্ণ জিতে পৃথিবীতে ইতিহাস রচনা করেন।

কারণ তাঁর আগে ঐ ইভেন্টে কেউ পরপর দু’বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হননি।

‘ক্যারলী’-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একটি মাত্র  হাত কাজে লাগিয়ে  ইতিহাস গড়ে গোটা বিশ্বকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, যতই প্রতিকূল হোক না কেন কখনও আশা ছেড়ে দেয়া উচিত নয়।

ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইচ্ছাশক্তিকে ধরে রেখে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে বাস্তবে সফল হওয়া বেশ সাধনার বিষয়।

সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে দেহের অন্যান্য পেশীর মত ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা ও বাড়ানো সম্ভব।

ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই। যার উদাহরণ ‘ক্যারলী’। 

ইচ্ছাশক্তি বাড়ানোর কৌশল

মেডিটেশন

মেডিটেশন এর কাজ হচ্ছে নিজের মস্তিস্কে (ব্রেন) নিজে নির্দেশনা দেয়া।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ধ্যানমগ্ন থাকলে কিছুদিন পর আপনি যে কোন কাজে ফোকাস করতে পারছেন।

নিয়মিত মেডিটেশন করলে মানসিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়বে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও ইচ্ছাশক্তি। কমবে মানসিক চাপ।

শারীরিক অঙ্গভঙ্গি

ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির গুরুত্ব অনেক।

বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে দু’দল লোকের উপর পর্যবেক্ষণ করে একদল লোককে সাধারণভাবে চলাচল করতে বলেন।

এবং অন্য দলকে তাদের চলাচলে সামান্য একটু পরিবর্তন করতে বলেন। পরিবর্তনটি হচ্ছে যখনি তারা নিজেদের মধ্যে আড়ষ্টতা অনুভব করবেন তখনই সোজা হয়ে বসবেন। অবাক বিষয় হচ্ছে এ সাধারণ অভ্যাস পরিবর্তন তাদের ইচ্ছাশক্তি অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

শর্করা জাতীয় খাবার

আমাদের খাদ্য থেকে শরীর গ্লুকোজ উৎপাদন করে থাকে।

এটি রক্তের সাথে প্রবাহিত হয়ে আমাদের ব্রেনে চলে যায় এবং আমাদের চিন্তাশক্তি, নতুন কিছু তৈরী করার বুদ্ধি আর ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

তবে সেটা পরিমিত হওয়া চাই যেন আমাদের রক্তে চিনির স্বল্পতা বা আধিক্য দেখা না দেয়।

পর্যাপ্ত ঘুম

ঘুম ঠিকমত না হলে এর প্রভাব পড়ে মনে। ব্রেনে একটা চাপ তৈরী হয়।

পর্যাপ্ত ঘুম হয় না হলে শরীর গ্লুকোজ তৈরী করতে পারে না, ফলে ব্রেনের যতটুকু চালিকা শক্তি প্রয়োজন ততটুকু শক্তি পায় না।

এতে আপনার মনের জোর বা ইচ্ছাশক্তি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

শরীর চর্চা

মানুষের শরীরে যা সহ্য করানো হয় তাই সহ্য হয়ে যায়।

তাই প্রথমে আলসেমি লাগলেও একটু একটু করে প্রতিদিন শরীরচর্চা করলে দেখবেন শরীর হালকা ঝরঝরে অনুভুত হচ্ছে।

তখন যে কোন কাজ উদ্যম নিয়ে করতে পারছেন।

আর শরীর যখন আপনার কমান্ড মানতে শুরু করবে ঠিক তখনি আপনার ইচ্ছাশক্তি হাজারগুণ বেড়ে যাবে।

বর্তমান কাজে মননিবেশ করুন

যখনি একটি কাজ হাতে নিবেন তখন সেই কাজটির প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করুন।

একসাথে একাধিক কাজ হাতে না নিয়ে একটি করে শেষ করুন। এতে মনোযোগ বাড়বে।

এ প্রক্রিয়াটি আপনার ব্রেনকে সাহায্য করে মনকে কেন্দ্রীভূত করে। প্রতিদিন চর্চার ফলে আপনার ইচ্ছাশক্তি বাড়বে।

নিজের সাথে কথা বলুন

বেশিরভাগ মানুষ যখন আয়নায় নিজেকে দেখে তখন সে মনে করে তার নাকটা আরো সরু হলে চমৎকার দেখাতো।

ইস যদি আরেকটু লম্বা হতাম বা আমার যদি লম্বা চুল হতো বা যদি ফর্সা হতাম বা আমার যদি অমুকের মত মাসল থাকতো আরও কত কী।

কিন্তু আমরা কখনো এভাবে ভাবি? যে আমি অন্যের চেয়ে অনেক দিক দিয়ে আলাদা। না ভাবি না।

এ না ভাবাটাই আমাদের আত্মতৃপ্তি দেয় না।

তাই এখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের খুঁত বের না করে নিজের গুণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।

দেখবেন আপনার আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি বেড়ে যাবে ইচ্ছাশক্তি।

অনুপ্রেরণা খোঁজা

কী আপনাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে থাকে?

আপনাকে উদ্দীপ্ত করে থাকে এমন কোন উপদেশ, কারো কথা বা বাণী, কারো সহচর্য, কোন কাজ, মিউজিক, খেলাধূলা ইত্যাদি যাই হোক না কেন অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজুন।

এ অনুপ্রেরণাই আপনার ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে দিবে।