Search
Close this search box.

রওনক আশরাফী প্রেমা: হার না মানা এক উদ্যোক্তার গল্প

বিয়ের আগে বাবার সন্তান, আর বিয়ের পর স্বামীর স্ত্রী— এভাবেই সাধারণত এই পরিচয়েই মেয়েদের জীবন শুরু ও শেষ হয়।

তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম কেউ কেউ থাকে যারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে, নিজের পরিচয় গড়ে তোলে, হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠিত।

আপনাদের সাথে এমনই একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো যিনি সামাজিক ও মানসিক শেকল ভেঙে মুক্ত হয়েছেন নিজ যোগ্যতায়, হয়ে উঠেছেন আজকের অনন্যা। 

ছোটবেলায় বাবার কাছে কাছে তকমা ছিলো ফাঁকিবাজ আর এখন সেই বাবাই গর্ব করেন তাঁকে নিয়ে। স্বামীর বোঝা হননি, হয়েছেন শক্তি।

তাইতো জীবনসঙ্গীর কাছ থেকেও পাচ্ছেন প্রাপ্য সম্মান।

পরিবার, বন্ধুমহল থেকে ভেসে আসছে ভালোবাসা, এই প্রতিটি অনুভূতিই তাঁকে আবেগে আপ্লুত করে, খুশির জোয়ারে ভাসায়।

বলছিলাম হার না মানা উদ্যোক্তা রওনক আশরাফী প্রেমার কথা।

তার বক্তব্য বেশ স্পষ্ট— একবিংশ শতাব্দিতে এসে ঘরে বসে থাকতে নারাজ তিনি।

তাঁর মতে, সবারই কিছু না কিছু করা উচিত নিজের জন্য। পরিবারকে বোঝানো উচিত এ ব্যাপারে।

রওনক আশরাফী প্রেমা

মনে জোর থাকলে এ যুদ্ধে জয় অনিবার্য

সাহস করে এ কথাগুলো বলার কারণে হয়তো অনেকের চক্ষুশূল হবেন তিনি। এটা মেনেই কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি মনে করেন, যারা এগিয়ে এসে সাফল্য পেয়েছে তাঁরা যদি সাহস না দেয় তাহলে বাকিরা পিছিয়ে থাকবে।

তাঁর এই কথায় কিংবা কাজে একজনও যদি অনুপ্রাণিত হয় তবে সেটাই তাঁর স্বার্থকতা। 

প্রেমার জীবনের গল্পটাও হতে পারে অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা।

ভিকারুন্নেসা স্কুল কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। ৪ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন সবার ছোট এবং আদরের।

বাবা ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের সরকারি কর্মকর্তা, মা গৃহিণী। 

পড়ুয়া ভাই-বোনদের মধ্যে প্রেমা ছিলেন একদম আলাদা। সারাদিন হৈচৈ করে বেড়াতেন। বকাও খেতেন খুব।

তবুও থেমে থাকেনি তাঁর চঞ্চলতা। কলেজে ওঠার পর কমার্স নিয়েছিলেন বিধায় তাঁকে নিয়ে সবাই ছিলো চিন্তিত, কারণ সেসময় তাঁর বাকি ভাইবোনের সব প্রতিষ্ঠিত। 

কলেজ শেষে বাবা ভর্তি করিয়ে দিলেন ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখে ভেবেছিলেন পড়াশোনার হয়তো তেমন প্রেশার হবে না।

সেই ভুল ধারণা ভাঙতে বেশি সময় লাগলো, সাথে আকাশও ভেঙে পড়লো। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া নিয়ে সিরিয়াস হলেন।  

গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতে না হতেই বিয়ে হয়ে গেলো। মন খারাপ হলো এই ভেবে যে জীবনে হয়তো আর কিছুই করা হবে না।

তবে চাকরি না করে ব্যবসা করতে উৎসাহ দিলো স্বামী। কিন্তু পরিবারের কেউই ব্যবসার সাথে জড়িত না থাকায়, উপায় না পেয়ে মন খারাপ বাড়তেই লাগলো। 

এমন একটা সময় ছিলো তখন, নিজের মনের কথাগুলো খুলে বলার সাহস ছিলো না।

এরই মাঝে বিয়ের পর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শুরু হলো সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে।

ইচ্ছা ছিল ব্যারিস্টারি পড়বেন। কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এমবিএ করেছেন, মেজর ছিলো এইচআর।  

জীবনটা দিনকে দিন কঠিন হয়ে গিয়েছিলো আশেপাশের মানুষের নোংরা মানসিকতায়।

অবস্থা এতোটাই ভয়ংকর হয়েছিলো যে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন পর্যন্ত হতে হয়েছিলো।

আমাদের এই সমাজব্যবস্থায়,  একটা মেয়ের জন্য বিয়ের পর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো যে কী পরিমাণ কষ্টের সেটা কোনো ছেলে আন্দাজ করতে পারবে না। 

স্বামী রাশেদুন নবীর সাথে প্রেমা

তারপরের গল্পটা ঘুরে দাঁড়ানোর

নতুন এক পথচলার শুরু।

প্রাথমিকভাবে, নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে ঘরে বসেই কিছু করার চেষ্টা।

এবং পরিস্থিতি বাধ্য করলো স্পষ্টবাদী এক মানুষ হতে। এতে ফিরলো মানসিক শান্তিও। 

প্রেমা যেসময় কাজ শুরু করেন তখন হাতেগোনা কয়েকটা পেইজ ছিলো ফেসবুকে।

একপ্রকার রিস্ক নিয়েই ২০১৬ সালে শুরু করেন নিজের এফ-কর্মাসভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান Shopping Glowrist- কাস্টমাইজড সব প্রোডাক্ট প্রোভাইড করাই ছিলো শপিং গ্লোরিস্টের মূল ফোকাস। প্রথমে কিছু না চিনলেও, আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে।

ব্যবসা শুরুর আগে অনেক ভেবেছেন। সময় পেলেই ইন্টারনেট ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। এরমধ্যে তার স্বামীর সঙ্গে থাইল্যান্ড যান ব্যক্তিগত কাজে।

থাইল্যান্ডের বাজার ঘুরে ঘুরে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন কাস্টমাইজড আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করবেন।

তখন বাংলাদেশে এসব আইটেমের প্রচলন কম ছিল। এভাবেই শুরু পথচলা।

শুরু হয় রেগুলার বেসিসে থাইল্যান্ড থেকে প্রোডাক্ট ইম্পোর্ট। আস্তে আস্তে রিটেইল থেকে শুরু হয় হোলসেল।

ভালো প্রোডাক্ট এবং সততা বজায় রাখার ফলে, মানুষজনও ভালোবাসতে শুরু করে। ব্যবসায়িক জোনে একটা বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠে। 

তখন ৫৫০ টাকা গড়ে প্রায় ৪৫টি অর্ডার পেয়েছিলেন। এই ৪৫ অর্ডারই এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ছিল প্রেমার।

২০২১ সালে এসে সে তালিকা বেশ লম্বা হয়েছে। ১৭ হাজার কাস্টমার যুক্ত হয়েছেন শপিং গ্লোরিস্টের সঙ্গে।

প্রতিমাসের হাজার খানিক কাস্টমারকে পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছেন প্রেমা।

তবে এখন শুধু কাস্টমাইজড আইটেমই নয়, যুক্ত হয়েছে থাই অরজিনাল কসমেটিকসহ আরও অনেক কিছু।

কাস্টমাইজড প্রোডাক্ট থেকে লেডিজ আইটেম, সবকিছুরই সাপ্লাই চলতে থাকে লোকাল মার্কেটে।

আরো বড় পরিসরে প্ল্যান ছিলো, কিন্তু তখনই করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিপর্যন্ত পুরো বিশ্ব। এর প্রভাব পড়ে ব্যবসাতেও।

রওনক আশরাফী প্রেমা

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যা বলেছেন প্রেমা

রওনক আশরাফী প্রেমা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, অনলাইন পেজের মাধ্যমে হোলসেলের বিজনেস করছি। আমার ফিক্সড কিছু পেজসহ অনেক শপ মালিক আছেন। পাশাপাশি অনেক কর্পোরেট ক্লাইন্টও আছেন। যাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রোডাক্ট দিচ্ছি।

গত বছর থেকে করোনার জন্য অনলাইনের রিটেল সাইট অফ রেখেছি। করোনার কারণে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো হলে অনলাইনে রিটেল কাজ শুরু করবো। ব্যবসার শুরুতে ২টি আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু আস্তে আস্তে ভ্যারাইটিজ আইটেম নিয়ে কাজ করতে হয়েছে।

স্পেশালি হোলসেল বেশি ফোকাস করা শুরু করেছি। যাই হোক, ব্যবসার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। ই-কর্মাস সাইটের লাইভ কর্মাস নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি।

পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে হেড অব এইচআর হিসেবেও কাজ করছি। এছাড়া একটি কানাডিয়ান ক্লাউড কিচেন কোম্পানির সঙ্গে কাজ শুরু করবো। সেখানে ইতালিয়ান এবং ইন্ডিয়ান ফুড আইটেম এতে প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হবে প্রতিষ্ঠানটির।  

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রওনক আশরাফী প্রেমা বলেন, ইচ্ছা আছে করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আউটলেট দেব বাংলাদেশে।

পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে নারীদের নিয়ে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান করবো, যেখানে যেসব নারীরা ব্যবসা করতে চান, যাদের কোনো সাপোর্ট নেই, কাউকে চিনেন না, ভয় পাচ্ছেন, কিভাবে কি করবেন তাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।

এছাড়া কিভাবে কাস্টমার হ্যান্ডেল করতে হয়, এমন বিষয়গুলো নিয়ে ট্রেনিং দেওয়া, যেন তারা ভালো মতো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই কিছু একটা করতে পারেন।  

রওনক আশরাফী প্রেমা

অনেক ভেবেচিন্তে এই সময়টাতে পা ফেলতে হয়

তবে এও ঠিক যে, করোনাকালে ঘরে বসেই অনেকে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করে সফল হয়েছেন।

তাই এই সময়টাতে ই-কমার্সের ঝোঁক বাড়তে থাকে। শপিং গ্লোরিস্ট থেকে শুরু করা প্রেমা, বনে যান পুরোদমে হোলসেল ব্যবসায়ী।

বেশ কিছু নতুন প্রজেক্ট সাথে জড়িয়ে কাজের ব্যাপ্তি বাড়ান। এতে সহায়তা করেন তাঁর স্বামী। 

এই গ্লোবাল প্যান্ডেমিকের সময়ে এসে বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, প্রেমা মনে করেন প্রতিটা মানুষেরই স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। বিশেষ করে মেয়েদের।

প্রতি ঘরে ঘরে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়া উচিত। ঠিক যেভাবে চীনে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে গেছে, সেভাবে আমাদের দেশেও সম্ভব।

শুধু প্রয়োজন অদম্য ইচ্ছা, চেষ্টা এবং নিজের মেধাকে কাজে লাগানো। তাহলে আমরাও একদিন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো।